প্রধান প্রতিবেদন
সহায়ক উপকরণ প্রস্তুতকারি সরকারী কোন উন্নতমানের প্রতিষ্ঠান নেই বাংলাদেশে। অপরদিকে বেসরকারি সংস্থার উচ্চমূল্যের কারণে প্রতিবন্ধী মানুষেরা এগুলো ক্রয় করতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের বিতরণকৃত সহায়ক উপকরণের গুণগত মান নিয়েও।
প্রতিবন্ধী মানুষের অভিযোগ প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের দেয়া উপকরণ দ্রুতই ব্যবহার উপযোগিতা হারায়। ফাউন্ডেশনের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র থেকে জানা যায়, ‘টেন্ডারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নিুমানের উপকরণ সরবরাহ করলেও কিছু করার থাকে না। কারণ প্রকিউরমেন্ট রুল অনুযায়ী সর্বনিম্ন টেন্ডার প্রণেতাকেই কাজ দেয়ার নিয়ম। এই নিয়ম ভঙ্গ করার ক্ষমতা সরকারি কর্মকর্তার নেই।’
প্রতিবন্ধী মানুষের চলাচলের সুবিধার্তে ব্যবহৃত সহায়ক উপকরণ নির্মাণের জন্য সরকারি পর্যায়ের কোনো নির্মাণকারি প্রতিষ্ঠান না থাকায় সমাজসেবা অধিদফতরের টঙ্গীস্থ শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও পূনর্বাসন কেন্দ্রে একটি কৃত্তিম অঙ্গ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করেছে। এ কেন্দ্রে শ্রবণ যন্ত্র, ক্র্যাচ, কৃত্রিম পা, হিয়ারিং এইড, ইয়ার মোল্ড তৈরি করা হচ্ছে। তবে এই সেবা নির্দিষ্ট গন্ডিতে সীমাবদ্ধ বলে জানালেন স্থানীয় একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। অর্ডারের ১৫ দিনের মধ্যে সহায়ক উপকরণ প্রদানের সময়সীমা থাকলেও বাস্তবে তা পাওয়া যায় না। ক্ষেত্র বিশেষে তা মাস ছাড়িয়ে যায়। এই কৃত্তিম অঙ্গ উৎপাদন কেন্দ্রে দক্ষ ও স্বীকৃত পেশাদার চিকিৎসক বা কন্সালটেন্ট নেই বলেও অভিযোগ আছে।
এদিকে উন্নতমানের সরকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্যে খুব শীঘ্রই কোন পরিকল্পনাও আসছে না। এ বিষয়ে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনাব নাসরিন আরা সুরাত আমিন জানান, জনবল সংকট, জায়গার সংকুলান ও বিভিন্ন প্রকার জটিলতার কারণে সরকারীভাবে সহায়ক উপকরণ নির্মাণের কারখানা/প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি এবং এই মুহুর্তে এটা নিয়ে তেমন কোন পরিকল্পনাও নেই।
এদিকে কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্থাপনে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পূনর্বাসন কেন্দ্র (নিটর) সেবা দিচ্ছে তা বেশ কয়েকবার জানতে চাইলে হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ তা এড়িয়ে যায়।
ওয়াকার, ক্রাচ, স্ট্যান্ডিং ফ্রেম, সাদা ছড়ি বা চশমার মত সহায়ক উপকরণ বাজারে বিভিন্ন বিক্রয় প্রতিষ্ঠান হতে খরিদ করে ব্যবহার করা সম্ভব হলেও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক উপকরণ যেমন: হুইলচেয়ার, কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যক্তিকেন্দ্রিক চাহিদার ভিত্তিতে ব্যবহার/স্থাপন না করলে তা বিজ্ঞানসম্মত এবং ব্যবহার উপযোগি নাও হতে পারে, বরং সেগুলো শারীরিক ক্ষতির ঝুকি বাড়িয়ে দিতে পারে। ব্যক্তি নির্ভর চাহিদাভিত্তিক সহায়ক উপকরণ নির্মাণে/স্থাপনে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি), সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন (সিআরপি) ও ব্র্যাক লিম্ব অ্যান্ড ব্রেস সেন্টার (বিএলবিসি) অন্যতম। বিএলবিসি সূত্রে জানা যায়, উপকরণ অনুযায়ী কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও ব্রেসের মূল্যভেদ আছে। একটি কৃত্রিম পা সংযোজন করতে ৩৫,০০০ থেকে শুরু করে ১,৫০,০০০ টাকা, কৃত্তিম হাত সংযোজনে ৫০,০০০ থেকে ৮০,০০০ এবং ব্রেস ও অন্যান্য কৃত্রিম যন্ত্রে ১,০০০-৩৫,০০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। সাধারনত মেটাল এবং উড এ্যাসিসটিভ ডিভাইস (সহায়ক উপকরণ) তৈরিতে ব্যবহৃত উপকরণগুলো দেশীয় ভাবে সহজেই পাওয়া যায় এবং সহজলভ্য। কিন্তু অর্থোসিস এবং প্রস্থসিসজনিত সহায়ক উপকরণ নির্মাণে ব্যবহৃত উপাদান (কাঁচামাল) বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। মূলত এই কারণে অর্থোসিস এবং প্রস্থসিসজনিত সহায়ক উপকরণগুলো সহজলভ্য হচ্ছে না বলে তথ্য দেন সিডিডি’র এক কর্মকর্তা।
গুরুত্বপূর্ণ এই সব সহায়ক উপকরণ প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য আকাশছোঁয়া, ক্ষোভের সুরে বলেন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মোহাম্মদ মহসিন। তিনি আরও বলেন, একে তো ব্যয়বহুল চিকিৎসাভার তার উপর সহায়ক উপকরণ কিনতে গিয়ে মোটা অঙ্কের খরচা আসলেই মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, একটি মোটোরাইজ বা অত্যাধুনিক হুইলচেয়ার-এর মূল্য পঞ্চাশ লাখ টাকারও উর্ধ্বে। আবার যেখানে চীনা হুইলচেয়ার পাওয়া যায় ৪০০০-৬০০০ টাকার মধ্যে, সেখানে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুকৃত হুইলচেয়ারের মূল্য দ্বিগুনেরও বেশি, একেকটি চেয়ার ১২০০০-১৮০০০ টাকা। এ ব্যাপারে সিআরপির কর্মকর্তা মাসুদ রানা বলেন, সিআরপিতে প্রস্তুতকৃত হুইলচেয়ার নির্মাণে উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় রড (লৌহ) যেখানে চীন হতে আমদানীকৃত হুইলচেয়ারে ব্যবহৃত হয় স্বল্পমূল্যের অ্যালুমিনিয়াম ধাতব। যেহেতু বিশ্ব বাজারে রডের মূল্য বেশি তাই এই কাচঁমালেই তাদের খরচ পড়ে যায় বেশি। তিনি আরও বলেন, সিআরপি প্রস্তুতকৃত হুইলচেয়ার ইংল্যান্ডের মটিভেশন নামক প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানের ডিজাইনৃত যা বাংলাদেশের বিদ্যমান অবকাঠামো ও ভৌগলিক পরিবেশের সাথে মানানসই যা গুণগত দিক দিয়ে চীনা হুইলচেয়ারের চেয়ে উন্নত।
অভিযোগ আছে দেশীয় নির্মাণকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সহায়ক উপকরণ সরবরাহ করতে নূন্যতম ২০ থেকে ৩০ দিন সময় নেন; অনেক সময় তা আরও দীর্ঘায়িত হয়। সরবরাহের এই দীর্ঘ সময় একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য হয়ে ওঠে দূরূহ। স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি’স ডেভেলপমেন্ট এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (সিডাব) এর সাধারণ সম্পাদক মেজর জহিরুল ইসলাম উদাহারণ টেনে বলেন, বিদেশে বিভিন্ন সাইজের সহায়ক উপকরণ তৈরি অবস্থায় পাওয়া যায়; যা সহায়ক উপকরণ ব্যবহারকারি অতি সহজেই তার মাপ অনুযায়ী তৎক্ষনাত ক্রয় করতে পারেন। তিনি নির্মাণকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরামর্শ দেন, অন্তত কিছু সংখ্যক বিভিন্ন মাপের সহায়ক উপকরণ তাৎক্ষনিক সেবার জন্য তৈরি অবস্থায় রাখা দরকার; যেন পরবর্তীতে তা স্ব-চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তন করে নেয়া যায়। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সহায়ক উপকরণের কারখানাগুলো মূলত ঢাকায় অবস্থিত। সুতারাং দেশের অন্যান্য অঞ্চলের প্রতিবন্ধী মানুষদের গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক সামগ্রী ক্রয় করতে ঢাকামুখী হতে হয়। অন্যদিকে বাইরে থেকে আমদানিকৃত সহায়ক উপকরণ মেরামতে রীতিমত নাকানি চুবানি খেতে হয়। যা ঢাকা ছাড়া অন্য জায়গায় মেরামত করা সহজ হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, আমদানিকারকগণ শুধুমাত্র সহায়ক উপকরণই আমদানি করেন; কোনরুপ যন্ত্রাংশ বা সংশ্লিষ্ট যন্ত্রাংশ না আনার ফলে মেরামত হয় না। যন্ত্রাংশের অভাবে তা বিকল হয়ে পড়ে থাকে, এতে সহায়ক উপকরণ ব্যবহারকারিকে পোহাতে হয় চড়ম বিড়ম্বনা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহায়ক উপকরণ ব্যবহারকারি বলেন, দেশের সর্বত্র যদি মানসম্পন্ন সহায়ক উপকরণ নির্মাণকারি বা সরবরাহকারি প্রতিষ্ঠান থাকত তাহলে শুধুমাত্র এই উপকরণগুলো ক্রয় বা মেরামতের জন্য সময়, শ্রম ও অর্থ খরচ করে ঢাকা আসা লাগত না।
দীর্ঘদিন যাবত হুইলচেয়ার ব্যবহারকারি জহিরুল ইসলাম ক্রেতাগণকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, উপকরণ ক্রয়ের পূর্বে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করতে- প্রথমত, ব্যক্তিকেন্দ্রিক চাহিদা (শারীরিক গঠন, চালনার দক্ষতা ইত্যাদি), দ্বিতীয়ত, ব্যবহারের সম্ভাব্য কাল (দীর্ঘস্থায়ী নাকি স্বল্পদিনের জন্য?) এবং পরিশেষে, পরিবেষ্টিত ভৌতিক অবস্থান ও ক্রয়ক্ষমতা। যাদের দীর্ঘদিন সহায়ক উপকরণ ব্যবহারের সম্ভাবনা আছে তাদেরকে টেকসই, স্ব-চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তন করে নেয়া যায়, মেরামত ও ব্যবহারে সহজ এবং মানসম্পন্ন সহায়ক উপকরণ ক্রয়ের উপদেশ দেন তিনি।
সরকারি পর্যায়ে সহায়ক উপকরণ নির্মাণের কোনরুপ সফল উদ্যোগ বা তৎপরতা না দেখায় তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, সরকার, বিভিন্ন উন্নয়নসহযোগি সংস্থা, সেচ্ছাসেবি সংগঠন, সমাজের বিত্তশালীসহ গণমাধ্যমের এ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে তা দেশের সকল অঞ্চলে প্রতিবন্ধী মানুষদের দ্বারগোড়ায় বিনামূল্যে বা সহনীয় মূল্যে পৌঁছানোর উদ্যোগ নিতে হবে।