জাহেদ খান
সমাজ মানেই বৈচিত্র্যে ভরপুর। তার মাঝে প্রতিবন্ধী মানুষেরাও রয়েছে। নানা বৈচিত্র্য আর ভিন্নতা নিয়েই একেকটি সমাজ গঠিত হয়। কিন্তু প্রতিবন্ধিতাকে অনেকেই অভিশাপ মনে করে। অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিজের প্রতিবন্ধিতার কারণে হতাশায় জীবন পার করে দেয়। কিন্তু প্রতিবন্ধিতা কি আসলেই অভিশাপ?
পৃথিবীর বিখ্যাত কয়েকজন প্রতিবন্ধী মানুষ যাদের অভিশপ্ত মনে করা হয়নি হয়তোবা। যারা নিজের প্রতিবন্ধিতাকে জয় করেছিলেন মেধা ও অদম্য মনের জোরে। যাদের সাফল্যগাথা এটাই প্রমাণ করে, প্রতিবন্ধিতা কখনো অভিশাপ হতে পারে না। একে জয় করতে শুধু প্রয়োজন দুর্নিবার সাহস আর অদম্য প্রেরণা। ওরা পারলে আমরাও পারি যদি নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে নিজের সৃষ্টিশীলতাকে ছড়িয়ে দিতে পারি… চলুন, জেনে নিই তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী।
বিটোভ্যানের নাম আমরা সবাই জানি। বিখ্যাত গায়ক ও সুরকার। যার গানের সুরের মূর্ছনায় বিশ্বের অসংখ্য মানুষ মুগ্ধ হয়েছেন। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, নিজের করা গানের সুর কখনোই শোনা হয়নি তার। তিনি একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ছিলেন। যা তাকে কখনোই দমিয়েও দেয়নি। নিজের সৃষ্টির আনন্দে মোহময় সংগীতে আঠারো শতকের প্রথম দিকে বিশ্বকে তিনি মাতিয়ে রেখেছিলেন।
মারলি বেথ মাতলিন একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধী অভিনেত্রী হয়েও ছিনিয়ে এনেছেন অস্কারের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর খেতাব। ১৯৮৬ সালে চিলড্রেন্স অব লেজার গড ছবিতে অভিনয় করে এ সম্মান পেয়েছিলেন তিনি।
বিখ্যাত আমেরিকান লেখক, লেকচারার হেলেন কেলার ছিলেন একজন শ্রবণ এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। আঠারো শতকের মহিয়সী এই নারী শ্রবণ ও দৃষ্টি শক্তি হারানোর পরেও অদম্য মনের জোরে স্পর্শের মাধ্যমে লিখতে ও বলতে শিখেছেন। পরবর্তীতে ১৮৮৭ সালে শিক্ষককতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি।
থমাস আলভা এডিসন, যিনি বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করে রাতের আঁধারেও বিশ্বকে আলোকিত করেছেন। একই সঙ্গে তিনি টেলিগ্রাফ পদ্ধতিরও আবিষ্কারক। যার নামে হাজারের মতো পেটেন্ট। তিনি ছিলেন শিখন প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন একজন ব্যক্তি। এটি স্নায়ুজনিত কারণে হয়। ফলে লিখতে, পড়তে এবং শিক্ষা অর্জনে ভীষণ সমস্যা হয়। এই ধরনের প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন
আরও কয়েকজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন, বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী থিওরি অব রিলেটিভিটির জনক আলবার্ট আইনস্টাইন এবং টেলিফোনের আবিষ্কারক আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল। তাদের প্রত্যেককেই শৈশবকালে পড়ালেখা শিখতে অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় পড়তে হয়েছে।
বিখ্যাত ইংলিশ কবি জন মিল্টন ছিলেন একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। যিনি তার বিখ্যাত মহাকাব্য ‘প্যারাডাইজ লস্ট’ রচনা করেছেন তার দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে। মারলি রুনিয়ান দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হয়েও চারদেয়ালে তাকে বন্দী করে রাখতে পারেননি তার বাবা-মা। দৌড়ানোর জন্যই যেন জন্ম হয়েছিল এই নারীর। নারীদের পাঁচ হাজার মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনি। অপর একজন সফল দৃষ্টি প্রতিবন্ধী গায়ক শিল্পী স্টিভি ওয়ান্ডার, যিনি একাধারে গায়ক, গীতিকার। এ ছাড়া বহু ধরনের সংগীতযন্ত্রের ওপর অসাধারণ পারদর্শিতা ছিল তার।
বিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংয়ের নাম সবাই জানি। যাকে বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান বিজ্ঞানী হিসেবে ধরা হয়। তিনি মোটর নিউরন প্রতিবন্ধিতার সম্মুখীন একজন ব্যক্তি। এর ফলে বিশেষ কম্পিউটারের সাহায্য ছাড়া লিখতে ও বলতে পারেন না তিনি বহু বছর ধরে। এ সময়কালের বিস্ময় এই ব্যক্তি যন্ত্রচালিত হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন এবং অসম্ভব রকমের এক শারীরিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জনপ্রিয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন ডি রুজভেল্টও হুইলচেয়ার ছাড়া চলাফেরা করতে পারতেন না। তিনি পোলিওর সম্মুখীন একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ছিলেন। বিখ্যাত চিত্রকর ফ্রিদা কাহলোও ছিলেন একজন পোলিও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। যার চিত্রকলার সৌন্দর্য্যে বিশ্ব অভিভূত, সেই ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ একজন মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ছিলেন।
এথলেট টানি গ্রে থম্পসন যিনি প্যারালিম্পিক প্রতিযোগিতায় ৯ বার স্বর্ণপদক জিতেছেন এবং ২০-এর মতো বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন, তিনি ছিলেন একজন পক্ষাঘাতগ্রস্থ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি।
আইরিশ লেখক এবং চিত্রকর ক্রিস্টি ব্রাউন একজন মস্তিষ্ক পক্ষাঘাত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যিনি এক পায়ের আঙুলের সাহায্যে লিখতে অথবা টাইপ করতেন। প্রাচীন গ্রিসের ডেমোস্থেনেস ছিলেন একজন স্ট্যামার। যিনি তো তো করে কথা বলতেন। অথচ একসময় তিনি গ্রিসের তুখোড় বক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।