বাড়ি19th Issue, March 201919th issue, March 2019সরকারি পরিসংখ্যানে অদৃশ্য প্রতিবন্ধী মানুষ; উপেক্ষিত এসডিজিতেও

সরকারি পরিসংখ্যানে অদৃশ্য প্রতিবন্ধী মানুষ; উপেক্ষিত এসডিজিতেও

ইফতেখার মাহমুদ/আহসান হাবিব

সরকারি পরিসংখ্যানে অদৃশ্য প্রতিবন্ধী মানুষেরা। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)তেও তারা উপেক্ষিত। অন্যদিকে চাপা পড়ে যাচ্ছে জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদ (সিআরপিডি) এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক আইন ও নীতিমালাগুলো। ফলে ক্ষমতাকাঠামোর বাইরে রয়ে যাচ্ছে প্রতিবন্ধী মানুষ।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগ (জিইডি) সম্প্রতি এসডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদন-২০১৮ প্রকাশ করে। এসডিজির সতেরোটি লক্ষ্যমাত্রার সাতটিতে সরাসরি প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী মানুষদের অগ্রগতির বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যানগত উপেক্ষার ফলে এসডিজি বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা ও গৃহীত উন্নয়ন কর্মসূচি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। একই সঙ্গে, তা প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়নকেও বাধাগ্রস্ত করে তুলেছে।

বিশ্লেষকদের মতে এসডিজি বাস্তবায়নের অন্যতম উদ্দেশ্য তথ্য-উপাত্তের বিপ্লব (ডেটা রেভল্যুশন) ঘটানো। কিন্তু উল্লেখিত প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসংশ্লিষ্ট সূচকসমূহে কোনো তথ্য উপস্থাপন না হওয়ায় সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি খর্ব হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। কারণ হিসেবে বিশ্লেষকেরা জাতীয় পর্যায়ের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক কমিটিগুলো সক্রিয় না থাকা এবং সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন। প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় আন্দোলনের অভাবকেও দায়ী করছেন প্রতিবন্ধী মানুষের নেতৃবৃন্দ। এ ছাড়া দীর্ঘদিনের প্রচলিত কল্যাণভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে উন্নয়ন কর্মকান্ডগুলো আবদ্ধ থাকছে দয়া-দাক্ষিণ্যের ঘেরাটোপে।

বাংলাদেশ এসডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদন ২০১৮ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তথ্যপ্রাপ্তির দিক থেকে ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম। এতে আরও দেখা যায়, এসডিজির ২৩২টি সূচকের মধ্যে বাংলাদেশের মাত্র ৭০টি সূচকের তথ্য রয়েছে। যেখানে ডেটা গ্যাপ অ্যানালাইসিস প্রতিবেদন ২০১৫ অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়ে তথ্য ঘাটতিতে ব্যাপক প্রকটতা দেখা গিয়েছিল, সেখানে দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এই অগ্রগতি প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি।

সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ একে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে সঠিক তথ্য সরবরাহের অভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য নেওয়া উন্নয়ন কর্মসূচিসমূহ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় সমাজকল্যাণের দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য এই প্রতিবেদনে নেই উল্লেখ করে প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ (পিএনএসপি) এর সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব বলেন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যবিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রবেশগম্যতা প্রভৃতি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগসমূহের ওয়েবসাইট, বার্ষিক প্রতিবেদন, বিশেষ প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী মানুষের কোনো ধরনের তথ্যের সন্ধান মেলে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হাউসহোল্ড ইনকাম সার্ভে এবং ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ্ সার্ভে এই প্রতিবেদন দুটিতে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যার বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও কৃষিশুমারি, কর্মসংস্থান জরিপ, নারীর ক্ষমতায়ন, সম্পদের মালিকানা অথবা অর্থনৈতিক অগ্রগতিবিষয়ক জরিপসমূহের কোনো সূচকে তাদের তথ্য পরিলক্ষিত হয় না। এমনকি দারিদ্র্যবিমোচন জরিপের কোনো অংশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু আমরা জানি, দেশের চরম দারিদ্র্যপীড়িতদের একটি বড় অংশ প্রতিবন্ধী মানুষ।

এই প্রতিবেদন প্রকাশ করতে গিয়ে সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগ (জিইডি) এর সদস্য জনাব শামসুল আলম বলেন, তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো শক্তিশালী ভ‚মিকা রাখতে পারে। এ প্রসঙ্গে জিইডি এর সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রকল্প পরিচালক ও যুগ্ম প্রধান ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জিইডি তথ্য-উপাত্ত ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান, সংগ্রহকারী নয়। তথ্য সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভ‚মিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ম্যাপিংয়ের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত (লিড) মন্ত্রণালয় এবং সহযোগী মন্ত্রণালয়ের ওপরও দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে।

তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহের ক্ষেত্রে এই মন্ত্রণালয়সমূহ কেন ভ‚মিকা রাখছে না, প্রতিবেদকের এই প্রশ্নের জবাবে তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়গুলোতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনসমূহকে জনওকালতি করার পরামর্শ দেন।

অপর দিকে বিবিএসের ডেমোগ্রাফি ও হেলথ বিভাগের উপপরিচালক ইফতেখাইরুল করিমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণের প্রক্রিয়া মাত্র শুরু করেছেন তারা।

প্রতিবন্ধী মানুষের তথ্য ঘাটতির সবচেয়ে বড় কারণ সরকারি কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়হীনতা বলে মনে করেন ভিজুয়্যালি ইমপেয়ার্ড পিপলস্ সোসাইটি (ভিপস) এর সাধারণ সম্পাদক নাজমা আরা বেগম পপি। তিনি বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভ‚মিকা এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে সক্রিয় আন্দোলনের অভাব উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, অবিলম্বে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর বাস্তবায়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

সিআরপিডির পরিবীক্ষণ কমিটির সদস্য এবং টার্নিং পয়েন্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক জীবন উইলিয়াম গোমেজ মনে করেন, তথ্য ঘাটতির অন্যতম কারণ প্রতিবন্ধী মানুষের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্বের অভাব। তা ছাড়া এসডিজির কারণে সিআরপিডির বাস্তবায়ন গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। আর প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনকে দয়া বা কল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার কারণে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বাইরে আমরা কিছু ভাবতে পারছি না।

এ প্রসঙ্গে এসডিজি অ্যালায়েন্স অন ডিসঅ্যাবিলিটির পরামর্শক নাফিসুর রহমান বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক আইনের জাতীয় সমন্বয় ও নির্বাহী কমিটি এবং সিআরপিডি পরিবীক্ষণ কমিটির সক্রিয় ভ‚মিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া আসন্ন ২০২১ সালের আদমশুমারিতে প্রতিবন্ধী মানুষের সঠিক তথ্য সংগ্রহের জন্য ২০১১ সালের তথ্য সংগ্রহের ফরমের প্রশ্নসমূহে ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণের তাগিদ দিয়ে তিনি এ বিষয়ে বিবিএসের সঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনগুলোকে আলোচনা করার পরামর্শ দেন।

সর্বশেষ

চাকরি নামক সোনার হরিণ নিয়ে যখন তামাশা!

প্রতিবন্ধী মানুষের জব প্লেসমেন্ট সংক্রান্ত সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ বিজনেস এন্ড ডিজেবিলিটি নেটওয়ার্ক (বিবিডিএন) এর সাথে বি-স্ক্যান’র গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তিনমাসের একটি চুক্তি হয়।...

মাসিক আর্কাইভ

Translate | অনুবাদ