সুমনা খান
দেশে বিপুলসংখ্যক প্রতিবন্ধী নারী। যার অধিকাংশই রয়েছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহ, কমিউনিটি ক্লিনিক, প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান ব্যবস্থা থাকা সত্তেও সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রয়েছে আঁধারে।
প্রতিবন্ধী নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বিভিন্ন প্রকার আইন ও নীতিমালায় বিশেষ বিশেষ পদক্ষেপের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি, ২০১১-এর মূলনীতি ৩-এ স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত গরিব, প্রান্তিক, বয়স্ক, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী জনগণের অধিক গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া এবং এ লক্ষ্যে বিরাজমান সম্পদের প্রাধিকার, পুনর্বণ্টন ও সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। আবার কর্মকৌশল ৩১-এ মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী, বয়স্ক জনগোষ্ঠী, পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীসমূহের স্বাস্থ্যসেবার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার কথা উল্লেখিত রয়েছে। এ জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচির উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩-এর ১৬ ধারার ‘ট’ ও ‘ঠ’ উপধারায় প্রতিবন্ধী মানুষের সর্বাধিক মানের স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তির অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-এর লক্ষ্যমাত্রা ৩-এ সকল বয়সী সকল মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চয়তার বিষয়ে এবং লক্ষ্য ৩.৬ এবং ৩.৭-এ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও নারীর জন্য প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চয়তার উল্লেখ রয়েছে।
সরকার সকল জনগণ বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারীর মৌলিক স্বাস্থ্য সুবিধাসমূহ নিশ্চিত করতে বিশেষ স্বাস্থ্যকার্যক্রম এবং নীতিগত ও আইনি নির্দেশনা দিয়ে থাকলেও প্রতিবন্ধী নারীরা মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন। বিগত ও বর্তমান সময়ে নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও প্রতিবন্ধী নারীদের স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পারিবারিক ও সামাজিক সুরক্ষা ও সচেতনতা তৈরিতে পরিবার ও রাষ্ট্রের চরম অবহেলা লক্ষণীয়। প্রতিবন্ধী নারীর বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে হরমোনজনিত সমস্যা, দীর্ঘ একটানা কাজ করা, স্নায়ুগত সমস্যা, ঋতুকালীন স্বাস্থ্যসুরক্ষায় জটিলতা, স্তন ক্যানসার, মাতৃত্বকালীন পরিচর্চার অভাব ও আর্থ্রাইটিস।
সাধারণ স্বাস্থ্যসেবায় অপ্রতিবন্ধী নারীরা সেবা পেলেও প্রতিবন্ধী নারীর জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। উদাহরণস্বরূপ- কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী নারীর স্বাস্থ্য বা রক্ত পরীক্ষায় সাধারণ সুচের পরিবর্তে বাটারফ্লাই সুচ ব্যবহার করা প্রয়োজন, সে বিষয়ে সেবাপ্রদানকারী দায়িত্বশীলগণ সচেতন নন। আবার গুরুতর প্রতিবন্ধী নারীদের রক্ত পরীক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণত ধমনি খুঁজে পাওয়া যায় না, সে ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের অজানা। ফলে সাধারণভাবে রক্ত দিতে না পারায় ভুক্তভোগী হন প্রতিবন্ধী নারীরা। আমি নিজে একজন স্নায়ু জটিলতার সম্মুখীন শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী। অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা কোনোটাই আমার জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। আবার শব্দদূষণ, আলোর প্রভাব, টানা পরিশ্রম এগুলোও আমার জন্য অনুক‚ল নয়। স্নায়ুকেন্দ্রিক ব্যথার জন্য ডাক্তার দেখালে বাংলাদেশের ডাক্তাররা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ সমস্যার জন্য ঘুমের ওষুধ দেন, যা আমার জন্য প্রযোজ্য নয়। চিকিৎসকেরা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে জ্ঞান, প্রয়োজনীয় গবেষণা ও প্রশিক্ষণের অভাবে প্রতিবন্ধী নারীরা সুষ্ঠ স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি অবকাঠামোগত প্রবেশগম্যতার অভাব নারীর এই স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। এ বিষয়ে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী জাকিরা জেরিন তরী সন্তান প্রসবকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা নেওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা স্মরণ করে জানান তিনি ওয়ার্ডে ভর্তি-হয়েছিলেন। সিজার অপারেশন হয় তার। সন্তান প্রসব পরবর্তী প্রবেশগম্য টয়লেটের অভাবে তিনদিন নিদারুণ যন্ত্রণায় ভোগেন। কেবিন ব্লকে স্থানান্তরিত হতে চাইলে দরখাস্ত, বিশেষ অনুমোদন ইত্যাদি ছুটোঠুটি করে তবেই কেবিন পান। মাঝের সময়ে টয়লেট করতে বাসায় যেতে হয়েছিলো তাকে। কেবিনের টয়লেটে হাই কমোড থাকলেও দরজা ছোট হওয়ার কারণে হুইলচেয়ার নিয়ে প্রবেশে সমস্যা দেখা দেয়। পরে টয়লেট ব্যবহারের সময় দরজা খুলে রেখে যেতে হতো। অন্যদিকে মস্তিষ্ক পক্ষাঘাত, মাস্কুলার ডিসট্রফি, মায়োপ্যাথি, প্রতিবন্ধী নারীর জন্য নিউরো সায়েন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি বিশেষায়িত হলেও এ বিষয়ে তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নেই। এ সম্পর্কে মাস্কুলার ডিস্ট্রফি প্রতিবন্ধী নারী সুমাইয়া বিনতে শফি বলেন, আমাদের দেশে মাস্কুলার ডিস্ট্রফি সম্পর্কে কোনো গবেষণা ও অভিজ্ঞতা না থাকায় চিকিৎসকেরা এ ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষদের সাধারণ চিকিৎসাসেবা দিতে নানা ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হন। তাই তার মতো ভুক্তভোগীরা বঞ্চিত হন চিকিৎসাসেবা থেকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে চিকিৎসা সেবা পাওয়া প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা হলেও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী তাদের প্রাপ্তির অপ্রতুলতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আবার বিভিন্ন ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার সময় প্রবেশগম্য যন্ত্রাংশের কথা উল্লেখ করে পোলিওর কারণে দীর্ঘদিন থেকে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী সালমা মাহবুব বলেন, বিভিন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রে এক্স-রেসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশের উচ্চতা বেশি হওয়ায় সমস্যা হয়। আবার কিছু পরীক্ষা আছে, যেগুলো দাঁড়িয়ে করানো হয়, যা হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে অনেক বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি আবারও বলেন, বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের জন্য স্বাস্থ্যনীতি, ২০১১; প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অনুসরণে প্রতিবন্ধী নারীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে প্রতিবন্ধী নারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ কর্মসূচি প্রতিবন্ধী নারীবান্ধব করতে সহযোগিতা করবে। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এর এনডিসি কর্মসূচির সহকারী কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ডা. এস. এম. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০১১ স্বাস্থ্যনীতিতে প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়ে আমি অবগত নই। তবে ইতোমধ্যে প্রতিবন্ধিতার ধরণ সনাক্ত করতে ওয়াশিংটন গ্রুপ অন ডিসঅ্যাবেলিটি স্টাটিক্স এর ছয়টি প্রশ্নকে মূলভিত্তি ধরে আমাদের একটি সমীক্ষা কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এতে ডাক্তাররা পরীক্ষার মাধ্যমে ২০১৩ সালের সহায়িকা অনুযায়ী ব্যক্তির প্রতিবন্ধিতা সনাক্ত করবেন। এছাড়াও তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব টয়লেট নেই এমন পঁচিশটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ভবন চিহ্নিত করেছে। তবে নতুন নির্মাণাধীন হাসপাতাল ভবনসমূহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব করতে নির্দেশনা দেওয়া আছে। হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের দাঁড়িয়ে এক্স-রে সংক্রান্ত সমস্যা বিষয়ে এ প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে তারা এ বিষয়ে অবগত নন বলে তিনি জানান।