শারীরিক প্রতিবন্ধিতাকে বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে, রূপকথার গল্পগুলোকে বাস্তবে নামিয়ে আনতে সফলতা অর্জনকারী চট্টগ্রামের এক অভিভাবক দম্পত্তি ও সেরিব্রাল পলসির সম্মুখীন তাদের সন্তানের মুখোমুখি হয় এবার অপরাজেয়।
সাক্ষাৎকারঃ সালেহ আহমেদ রাখি। লেখনী রূপঃ সাজিয়া আফরিন তন্বী।
মোটামুটি ভালই ব্যস্ততায় দিন কাটান চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান। ঘরের বাইরে ব্যস্ত তিনি। তার স্ত্রী গুলশান আরা ঘরেই ব্যস্ত। তাদের একমাত্র সন্তান মোঃ আজিজুর রহমান নাবিলকে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দৃপ্ত প্রত্যয় নিয়েছেন যেন বাবা মা দুজনেই।
চট্টগ্রামে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরেজিতে অনার্স ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী নাবিল বইয়ের রাজ্যে বাস করে। সংগ্রহে তার প্রচুর বই। এমনকি প্রায় ৪০-৫০ বছর আগের রুশ বই নামে পরিচিত বেশ কিছু বই। যেগুলো রাশিয়া ভেঙ্গে যাবার পর আর বাজারে আসে নি। সময় পেলেই নানা ধরণের বইয়ের রাজ্যে ডুবে যায় সে। সিনেমা দেখা, ভিডিও গেম খেলা আর প্রাচীন জিনিসপত্র সংগ্রহের ঝোঁক তার। রীতিমত বই আর পয়সার স্তূপ জমিয়ে ফেলেছে সে।
শুক্রবারের এক সকালে নাবিলদের বাসায় কথা হচ্ছিলো তার বাবা ও মায়ের সাথে। জানা যায় ১৯৯৫ সালে জন্মের চারদিন পরপরই জন্ডিস ধরা পড়ে নাবিলের। সে সময় তাকে টানা পনেরদিন তিনবেলা ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছিল। জন্ডিসের জন্য দেয়া ফটোথেরাপি নেয়ার সময় নাবিল খুব হাত পা ছুটোছুটি করত। ইঞ্জেকশনগুলি দেয়ার সময় থেকেই তাদের মনে সন্দেহ হয় তার পায়ে সমস্যা হয়েছে। কিন্তু ডাক্তারদের ভাষ্যমতে নাবিলের জন্মের সময় মস্তিষ্কে আঘাত থেকে সৃষ্ট সেরিব্রাল পলসি বা সিপি। ছয়মাস বয়সী নাবিলের পিতামাতা লক্ষ্য করলেন ছোট্ট ছেলেটিকে বসালে সে পড়ে যায়। এরপর একসময় দেখলেন সে দাঁড়াতেও পারে না। তখন তারা অর্থপেডিক, ফিজিওসহ বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে নাবিলের চিকিৎসা শুরু করলেন। পরবর্তীতে ঢাকায় কল্যানী নামক প্রতিষ্ঠানে দেখানোর পর জানা গেলো নাবিলের বিভিন্ন রকম ব্যায়াম ও থেরাপি দরকার। সাত-আট বছর বয়সে অর্থপেডিক ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ি অপারেশান করা হলে ওর হাত-পা কুঁচকে যায়। ডাক্তাররা জানান পরবর্তীতে চিকিৎসা হলে ধীরে ধীরে হাত পায়ের এই সমস্যা কেটে যাবে। আর সে বড় হয়ে নিজে নিজেই কিংবা কোন কিছুর সহায়তায় চলাফেরা করতে পারবে। ডাক্তারদের অনেকেই দেশে অপারেশনের কথা বলেছিলেন। তবে অন্যান্যদের পরামর্শে ভারতে মাদ্রাজের এপোলো হাসপাতালে অপারেশান করানো হয়। ফলে নাবিলের পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ানোর সমস্যাটা ঠিক হয়ে যায়। তবে ওয়াকারের সাহায্যে হাঁটাচলা করতে হত তাকে।
তবে নাবিলের বাবা কথা প্রসঙ্গে আফসোস করলেন, ওর যখন নিয়মিত ব্যায়াম করাটা খুব দরকার ছিল তখন সেটা তারা পারিবারিক নানান সমস্যার কারণে করে উঠতে পারেন নি। তিনি তার ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ত থাকতেন। ফলে রাতে এসে নিয়মিত সময় দিতে পারতেন না। আর নাবিল ছোটবেলায় তার মায়ের সাথে ব্যায়ামগুলো করতে চাইত না। ব্যায়াম করানোর জন্য কাউকে রাখাটাও সম্ভব হয় নি। পরবর্তীতে নাবিলেরও লেখাপড়ার ব্যস্ততা বেড়ে গেলো। তাদের এবং ডাক্তারদের বিশ্বাস নিয়মিত ব্যায়াম করা হলে হয়ত সে এখনকার চেয়ে আরো বেশি ভালো অবস্থায় থাকত। একজন থেরাপিস্ট কিছুদিন ব্যায়াম করিয়েছেন। এমনকি মাঝে কিছুদিন ওর বিদ্যালয়ের পিটি স্যার ব্যায়াম করিয়েছেন, যিনি পরবর্তীতে বদলি হয়ে গেলে তাও বন্ধ হয়ে যায়।
আসলে মুখে বলা যতটা সহজ কাজে করাটা তারচেয়ে অনেক কঠিন। নিজেরা না পারলে লোক দিয়ে করানো এটা অনেক খরচ, তাছাড়া সে সময় প্রতিদিন পাঁচশ টাকা করে প্রতি মাসে শুধু ব্যায়ামের জন্য লোক নিয়োগ দেয়া তাদের পরিবারের পক্ষে সম্ভব ছিলো না।
আর্থিক সচ্ছলতা ভাল হলে এদেশে প্রতিবন্ধী সন্তানকে লালন পালন হয়তো সহজ হয়ে যায়। আজ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সচ্ছলতা এসেছে ঘরে। কিন্তু নাবিলের পিতা-মাতার কাছে সামাজিক প্রতিবন্ধকতাগুলো কখনোই তেমন সমস্যা মনে হয় নি এবং সৌভাগ্যক্রমে নাবিলের আত্নীয় স্বজনেরা অনেক সহযোগি মনোভাবাপন্ন ছিলো। নাবিলের ওয়াকার নিয়ে চলাফেরা সত্ত্বেও কেউই কখনো এ নিয়ে কটু মন্তব্য করে নি তার সামনে। বরং তার চাচাতো মামাতো ভাই বোনের সাথে চমৎকার সম্পর্ক ছিল। সবাই ওকে দেখে রাখার ব্যাপারে অনেক সহযোগিতা করেছেন। ওকে নিয়ে এখানে-সেখানে ঘুরেও বেড়িয়েছে। তবে নাবিল নিজেই অনেক সময় বাইরে যেতে চাইত না। মাঠে অন্যান্য শিশুদের সাথে খেলতে যেতে চাইত না। আত্নীয় স্বজনের বাসায় ঘুরতে যেতেই বেশি পছন্দ করত।
নাবিলের বাবা জানালেন ছোটবেলা থেকেই সে তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী ছিল। ব্যায়ামের প্রতি অনীহা থাকলেও পড়ালেখার প্রতি তার ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করেছিলেন তারা। ছয় বৎসর বয়সে নাবিলকে কনসেপ্ট কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে নার্সারীতে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। সেই থেকে তার শিক্ষাজীবনের পথচলা শুরু। বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনী হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং কলেজ অব সায়েন্স এন্ড বিজনেস হিউম্যানিটিজ (সিএসবিএস) থেকে এইচএসসি পাশের পর বর্তমানে নাবিল চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীতে অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র ।
মোস্তাফিজুর রহমান বললেন তীব্র ইচ্ছেশক্তি আর আগ্রহ কখনও হতাশা ভর করতে দেয় নি নাবিলের ওপর। নাবিলের ইচ্ছেশক্তি ও তীব্র আগ্রহ তাদের অনুপ্রাণিত করেছে। সন্তানের শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে তাই তাকে সাধ্যমত সহযোগিতা করেছেন সবসময়। বিদ্যালয়ের বন্ধুবান্ধবী, শিক্ষক-শিক্ষিকাগণও নাবিলকে সবসময় যথেষ্ঠ সহযোগিতা করেছেন। চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে ভর্তি সুযোগ পাওয়ার পর শিক্ষকদের পরামর্শে এবং শ্রেণিকক্ষগুলো ওপরে নিচে হওয়ায় চলাফেরায় সুবিধে বিবেচনা করে তাকে বেসরকারি কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন তারা। কলেজে ওর জন্য দোতলার ক্লাস নিচতলায় নিয়ে আসা হয়েছিল। কলেজের অধ্যক্ষও খুব সহযোগিতাপূর্ণ এবং আন্তরিক ছিলেন।
নাবিলের গৃহিণী মা সর্বদা ছেলেকে আগলে রেখেছেন। বাবা শত ব্যস্ততার মাঝেও নাবিলকে সময় দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা নাবিলকে সবসময় তাদের সাথে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছেন। পরিবারের সাথে গ্রামের বাড়ি, বান্দরবন, কক্সবাজার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়েছে বলে জানালেন নাবিল। এমনকি নাবিল এখন তার বন্ধুদের সাথে একা একা ঘুরতে যায়। প্রতিবন্ধী সন্তানকে গৃহবন্দী করে রাখা কখনোই উচিৎ নয় বলে জানালেন গর্বিত এই বাবা মা দুজনেই।
নতুন কোথাও ঘুরতে গেলে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন অনেকেরই। আবার কখনও কখনও কটুকথাও শুনেছেন। কেউ বিরক্ত হয়ে বলেছেন “এধরণের বাচ্চা নিয়ে ঘুরতে বের হওয়ার দরকার কি?” আবার অনেকেই নিজ থেকে এসে খোঁজ নিয়েছে নাবিলের। চড়াই-উতরাই জীবনেরই অংশ বৈকি। একবার পড়ে গেলে উঠে দাঁড়াবার শক্তিটুকু থাকতে হবে আমাদের। তাই এসব কটুকথায় কান দেন নি তারা।
বরঞ্চ অদূর ভবিষ্যতে নাবিলের আত্ননির্ভরশীলতা নিয়েই ভেবেছেন তারা। শিক্ষা জীবনের পাশাপাশি নাবিল নিজেও স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা করছে এখন থেকেই। তার নিজের দুটি অনলাইন স্টোর রয়েছে যার একটি বইয়ের অন্যটি টি-শার্টের ইভোলিউশন।
এই পর্যায়ে প্রসঙ্গক্রমে নাবিলের বাবা জানালেন, আর্থিক সমস্যার কারণে একটা সময় নিয়মিত থেরাপিস্ট রেখে তার নিয়মিত ব্যয়াম করাতে পারি নি। আমি আমার অবস্থান থেকে যতটুকু পেরেছি করেছি। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী সন্তানের লালন পালন, তাদের সঠিক পরিচর্যা ও সুচিকিৎসার সুযোগ সুবিধে নেই এদেশে এবং যারা একেবারেই অসচ্ছল অভিভাবক তারা হয়ত কিছুই করতে পারবে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েরা শিক্ষা, যাতায়াত, সর্বক্ষেত্রে প্রবেশম্যতার নানান সুযোগ সুবিধে রয়েছে।
সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে তিনি আশাবাদী। তবে এটা যার যার দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। যারা প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে কটুকথা বলে কিংবা অবহেলার দৃষ্টিতে দেখে তাদেরকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। আমাদেরকেই সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। যতদিন না বুঝবে ততদিন চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যথাটুকু অনুধাবন না করতে পারলে আমরা কখনই তাদের পথচলার সাথী হতে পারব না।
বাংলাদেশের নাগরিক অধিকার বঞ্চিত প্রতিবন্ধী সন্তানের বাবা মার উদ্দেশ্যে বললেন, প্রতিবন্ধী মানুষেরাও এদেশের নাগরিক। ভোটার আইডি কার্ডের মাধ্যমে ওরাও দেশের নাগরিকত্ব পাচ্ছে। দেশের এসকল সুবিধাবঞ্চিত নাগরিককে তাদের সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকেও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের চেষ্টা আছেই। কিন্তু এর বাস্তবায়নে আমাদেরও জোরদার পদক্ষেপ নিতে হবে। আর যাদের সামর্থ্য নেই তাদেরকে সহযোগিতা করতে পারে নানা ধরণের সংগঠন। সর্বোপরি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।