প্রতিবন্ধিতার বহুমাত্রিকতা

এস, এম, গোলাম মোস্তফা

 

প্রতিবন্ধীরা অসুস্থ নয়, তাদেরও আছে শক্তি

বাক ও শ্রবণে বাধাগ্রস্থ, তাদেরও আছে উক্তি

সাইন ল্যাংগুয়েজ, হিয়ারিং এইডে কথার অভিব্যক্তি।

 

চোখের দৃষ্টি হারিয়েছে যারা, তাদের দিব্য দৃষ্টি

অন্তর্দৃষ্টির প্রখরতা রয়েছে, অপূর্ব তাদের সৃষ্টি

ব্রেইল তাদের করেছে ঋদ্ধ, সমাজ সংসার কৃষ্টি।

 

অটিস্টিক এখনও মিস্টিক, আছে কারো দিব্যজ্ঞান

মুদ্রাদোষে দুষ্ট হলেও, থেমে নাই তাদের অবদান

অপূর্ব সৃস্টির মাধ্যমে কেউ কুড়িয়েছে ধন-মান।

 

বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সে যার বুদ্ধি রয়েছে অনেক কম

আচার আচরণে অসহনীয় হলে সমাজে নেই দাম

তাদের দেখে শিক্ষা নিলে সবাই হবে লাভবান।

 

শরীরের অংগ হলে ভগ্ন, প্রতিবন্ধী হয় শারীরিক

দূর্ঘটনার শিকার হলে, হয় প্রতিবন্ধিতার শরীক

তাদের দিকে ইংগিত করে কেউ করো না ’ধিক’।

 

প্রতিবন্ধিতা শুধু শরীরে নয়, মনেও রয়েছে বিস্তর

কুপমন্ডুক মনেই প্রকৃত ’বিবেক প্রতিবন্ধিতা’ সোচ্চার

ন্যায্য দাবী আদায়ের জন্য চাই সচেতনতার বিস্তার।

 

তোমার আমার ভাইবোন তারা একই সমাজের অংগ

তাদের সাথে সব বৈষম্যের খেলা করতে হবে সাংগ

দৃষ্টিভংগির পরিবর্তন কর, হোক তোমাদের মোহভংগ।

 

প্রতিবন্ধিতার অক্ষমতায় যাদের করেছ বন্দী

তাদের সাথে আজ তোমাদের করতে হবে সন্ধী

ভেংগে খান খান হবে তোমাদের সব কুকর্মের ফন্দী।

ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গ

মোস্তফা কামাল যাত্রামনো-দৈহিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিবিধানমূলক নাট্যক্রিয়া অনুশীলন নাট্য সংস্থা উৎস (UTSA) ১৯৯৭ সাল থেকে চট্টগ্রামের প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে কাজ করে আসছে। চট্টগ্রাম বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ইনষ্টিটিউট, হাই-কেয়ার হিয়ারিং সেন্টার এন্ড স্কুল এবং স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা ইপসা’র উপকারভোগীদের নিয়ে স্বল্প সময়ে থেরাপিউটিক থিয়েটার-এর বিভিন্ন অনুষঙ্গের প্রয়োগ করতে গিয়ে যে পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে, তাকে সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে দাতা সংস্থা একশন এইড বাংলাদেশের আর্থিক সহযোগিতায় ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে “থিয়েটার থেরাপি সেন্টার অব দ্য ডিজএ্যাবল্ড (টিটিসিডি)”।

টিটিসিডি কেন্দ্রিয়ভাবে মনো-বিশ্লেষক নাট্য অধিবেশন পরিচালনার পাশাপাশি উৎস (ইউটিএসএ) এর তত্ত্বাবধানে ‘জাতীয় প্রতিবিধানমূলক নাট্য কর্মশালা’ আয়োজনের মাধ্যমে মনোসামাজিক নাট্যক্রিয়া পরিচালনায় দক্ষ থিয়েটার থেরাপিষ্ট গড়ে তুলতে ছিল সর্বদাই সচেষ্ট। এসব কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার বিখ্যাত মনো-বিশ্লেষক নাট্য বিজ্ঞানীরা।

চট্টগ্রামেরই আরেকটি স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সংশপ্তক’ -এর নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক ও বিনোদন কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং প্রতিভার উন্মেষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আমাদের আরও উৎসাহিত করে তুলে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) সংশপ্তকের উদ্যোগকে আরও সমৃদ্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

মনো-বিশ্লেষক নাট্যের পাশাপাশি প্রতিবন্ধিতা ইস্যুতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে সচেতনতামূলক নাটকের প্রদর্শনী আয়োজনে উৎস’র অভিজ্ঞা, সংশপ্তক, ইপসা, বিটা ও ওয়াচ’সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত আয়োজন, যেসব প্রতিভার আবিষ্কার করেছে তা আমাদের সমাজের জন্য এক দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ।

অপরদিকে ক্রীড়া ক্ষেত্রে ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ক্রীড়া সমিতি’র সমর্থনে    ‘চিটাগাং সোসাইটি ফর দ্যা ডিসএ্যাবল্ড (সিএসডি)’ ২০০৫ সাল থেকেই চট্টগ্রামে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্রীড়ার বিকাশে আয়োজন করে আসছে ‘বিভাগীয় প্রতিবন্ধী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা’। এ প্রক্রিয়াকে আরও সুসংগঠিত করতে চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছে ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ক্রীড়া সমিতি- চট্টগ্রাম শাখা’। বর্তমানে চট্টগ্রাম ভিত্তিক উক্ত সংগঠন-দ্বয়ের পাশাপাশি চট্টগ্রামে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ক্রিকেটের অনুশীলন ও বিকাশে কাজ করছে ‘চিটাগাং ব্লাইন্ড ক্রিকেট ক্লাব (সিবিসিসি)’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান।

প্রতিবছর বিভাগীয় প্রতিবন্ধী ক্রীড়া সংস্থা, এ্যালায়েন্স অব আরবান ডিপিও’স ইন চিটাগাং (এইউডিসি), ডিজএ্যাবিলিটি রাইটস গ্রুপ (ডিআরজি) এবং উৎসের আয়োজনে ওয়ার্ড ভিত্তিক প্রতিবন্ধী ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজনকে ঘিরে চট্টগ্রামে যে উদ্দীপনা ও উৎসাহ সৃষ্টি করে তা অভাবনীয়। তবে একে মূল স্রোতধারায় আরও বেশি করে অন্তর্ভুক্ত করতে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া পরিষদ, চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সমিতি, জেলা শিল্পকলা একাডেমী, শিশু একাডেমী এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত ‘থিয়েটার ইনষ্টিটিউট চট্টগ্রাম (টিআইসি)-কেও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।

ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিগত এক দশকে বেসরকারি পর্যায় থেকে যে ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় পরিচালিত হয়েছে; তার ফলাফল স্বরূপ আমাদের প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদ ও শিল্পীরা জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়েও রেখে চলেছে প্রতিভার স্বাক্ষর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই দিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টি নেই চট্টগ্রাম জেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম জেলা প্রতিবন্ধী কল্যাণ কমিটির।

জাতীয় প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১ অনুযায়ী, উক্ত জেলা প্রতিবন্ধী কল্যাণ কমিটি প্রতি ২ মাসে ন্যূনতম ১টি সভা করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একীভূত সমাজ প্রতিষ্ঠায় নানান উদ্যোগ নেওয়ার কথা। কিন্তু উক্ত সভাটি নিয়মিত হয় না। যার ফলে জেলা প্রতিবন্ধী কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী কর্মসূচী বাস্তবায়নও হয় না। অন্যদিকে এই কমিটিতে নেই বিভাগীয় ক্রীড়া সমিতি পরিষদের কোন প্রতিনিধিত্ব। আমরা চলমান এই নেতিবাচক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে চাই। চাই জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবন্ধী বান্ধব ইতিবাচক ও কার্যকর পদক্ষেপ। ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় কেন্দ্রিয়ভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যে উদাসীনতা প্রদর্শন করছে; তা সত্যিই বিমাতাসুলভ। এই মানসিকতার পরিবর্তন এনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য পরিকল্পনা ও ইতিবাচক উদ্যোগ নেবেন এটাই এখন সময়ের দাবি।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, উৎস, চট্টগ্রাম।

“জীবনে ফুল ফোটা হলে মরণে ফল ফলবে”

কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিন অনেক ফোনকল রিসিভ করি। কলগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এবং কখনো কখনো  দেশের বাইরে থেকেও আসে। প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে ফোন রাখার পরে ঐ প্রান্তে যার সাথে কথা বলি তাকে আর মনে থাকে না। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের সাথে কথা বলে ফোন রাখার পরেও রেশ রয়ে যায়। তাদের সর্ম্পকেও জানতে ইচ্ছে করে।

তেমনি একজনের কথা আজ আপনাদের বলব। তিনি ফোন করেছিলেন আজ থেকে বেশ ক’বছর আগে। পরিচিত একজনের কাছ থেকে আমাদের নাম্বার পেয়ে রিং দিলেন।

উনি হুইলচেয়ার ঠিক করাবেন। আমি সবিস্তারে সব তথ্য দেবার পর ফোন রেখে দিলাম যথারীতি। কিন্তু ফোন রাখার পরে মনে হতে লাগল ঐ কন্ঠে কি যেন ছিল!  কাজের ফাঁকে বসে বসে ভাবতে লাগলাম আবার যেন উনি ফোন করেন। কেন যেন উনার সর্ম্পকে জানতে ইচ্ছে করছে। হ্যাঁ ক’দিন পর আবার সেই ফোন এলো। আমি প্রবল উৎসাহে কথা শুরু করলাম।

এইবার আমি উনার সর্ম্পকে জানতে চাইলাম। নাম ঠিকানা জানার পর জিজ্ঞেস করলাম হুইলচেয়ার কার জন্য? উনি বললেন,“আমার নিজের জন্য”। উত্তরটা শুনে অবাক হলাম। কারণ আমি যে সব কল রিসিভ করি সে গুলোতে সাধারণত কোন প্রতিষ্ঠান থেকে অথবা কোন অভিভাবক হুইলচেয়ার সর্ম্পকে খোঁজখবর নেন। কখনো কোন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী নিজে তার হুইলচেয়ার সর্ম্পকে জানার জন্য ফোন করেননি।

যাই হোক আমার আগ্রহ আরো বেড়ে গেলো। উনি কি করেন জানতে চাইলাম।

বললেন, ‘কিছু করি না’। কিন্তু আমার কাছে উনার সাথে কথা বলে উনাকে খুব ম্যাচিউরড একজন মানুষ বলেই মনে হয়েছে।

আমি বলি ওহ্ আচ্ছা, তাহলে পড়াশোনা করেন বুঝি? উনি বললেন, ‘নাহ পড়াশোনাও করি না’। উনার নির্লিপ্ত কন্ঠস্বর আমাকে আরো আগ্রহী করে তোলে। আমি বলি-  পড়াশোনাও করেন না, চাকরীও করেন না তাহলে সারাদিন কি করেন?

উনি ঠান্ডাস্বরে বললেন, ‘টিভি দেখি, খাই আর ঘুমাই’।

প্রথম পরিচয় তবুও ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে জিজ্ঞেস করি – বয়স কত আপনার?  উনি অকপটে বললেন, ‘ছত্রিশ বছর’। উনার উত্তর শুনে মাথাটা গরম হয়ে উঠে।  আমার কন্ঠ থেকে কেমন যেন উষ্মা ঝরে পড়ে। ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছি এই কথা মনে রাখতে ইচ্ছে করে না।  বলি-  ছত্রিশ বছর হয়ে গেল! কিছুতো শুরুই করেননি আর কবে করবেন?

উনার নির্লিপ্ত জবাব-‘করব’।

আমি অবাক হয়ে বলি আর কবে করবেন! ঘড় সংসারও করেন না তাহলে সারাদিন সময় কাটানতো মুশকিল।

বাইরে ঘুরে বেড়ান নিশ্চয়। উনি বললেন, ‘নাহ্ কোথ্ওা যাই না সারাদিন ইট পাথরের চার দেয়ালের ভিতরে বসে থাকি। বাইরে যেতে ইচ্ছে করলেও যেতে পারি না। হাঁটতে না পারলে কে নিয়ে যাবে? হুইলচেয়ার নিয়ে বাইরে বেড়াতে যাওয়া অনেক ঝামেলা’।

জানতে চাই কি হয়েছিল? হুইলচেয়ার ব্যবহার করেন কেন? বললেন, “পোলিও। তিন/চার মাস বয়সে অসুখ ধরা পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় ডাক্তারৃ কোথায় বৈদ্য তবুও চিকিৎসার কোন ত্রুটি করেননি বাবা মা কিন্তু এই জীবনে আমি দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতেই পারলাম না।  তাই হাঁটতেও শিখিনি। আমার চারপাশে এতো মানুষ হেঁটে বেড়ায় অথচ আমি?  আমি জানতেই পারলাম না হাঁটার অনুভূতি কেমন। তবে দু’বছর হল আমার একটা হুইলচেয়ার কেনা হয়েছে”।

জিজ্ঞেস করলাম-  কেন এত বছরে কেনেননি?  উনি বললেন, “আগে ভাড়াবাসায় থাকতাম ওখানে এতো ছোট ছোট রুম ছিল যে হুইলচেয়ার নিয়ে চলাফেরা করার মত জায়গা ছিল না। এখনতো নিজেদের বাড়ীতে উঠে এসেছি। হুইলচেয়ার নিয়ে এই রুম ঐ রুমে ঘুরতে পারি। আগে সারাটাদিন এক জায়গায় বসে থাকতে হত। বিছানা বা সোফা যেখানে বসিয়ে রাখত মা সেখান থেকে আরেকবার সরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত পাথরের মত বসেই থাকতাম”।

আমি এই প্রথম কারো কন্ঠে এতোটা আত্মতৃপ্তির স্বর শুনতে পেলাম; যে কিনা হুইলচেয়ার পেয়ে কিছুটা হলেও স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে।

উনার কথা শুনে আমার মন কেমন কেমন করে।  মাথা থেকে বিরক্তিভাবটা আস্তে আস্তে চলে যেতে থাকে। আমি বলি, আচ্ছা তাহলেতো আপনি ঘরে বসে গল্প উপন্যাস লিখতে পারেন। উনি বললেন, “গল্পের বই পড়ি কিন্তু লিখতে ভাল লাগে না”।

আমি বলি, ‘ঠিক আছে গল্প লিখতে ভাল না লাগলে সারাদিন যে ভাবে সময় কাটান সেটাই না হয় লিখতে শুরু করেন। এ্যানাফ্রাঙ্কের ডায়রীর মত আপনার লেখাও বিখ্যাত হয়ে উঠবে’।

উনি বলেন, “আমার লেখার মত কোন বিষয়ই নাই। কি নিয়ে লিখব শুধু শুধু!  তাছাড়া বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখব সেই ক্ষমতাও আমার নেই”।

আমি তবুও হাল ছাড়ি না। নাছোড়বান্দার মত বলতেই থাকিৃ…

উনি বলেন, “কি হবে এইসব ছাইপাশ লিখে?”

আমি বলি, “মানুষ জানবে দিনের পর দিন চারদেয়ালের ভিতর বসে থাকতে কেমন লাগে। এই যুগেও কেউ এই ভাবে থাকে?”

উনি বলেন, “করব… করব…  আমিও কিছু করব সময়তো চলে যায়নি”।

উনার আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর শুনে আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। মনে মনে ভাবি এতোটা বছর পার হয়ে গেল কিছু শুরুই করেননি;  আর কবে যে করবেন!

এই ছিল উনার সাথে আমার প্রথম দিককার ফোনালাপ। এরপর প্রায়ই আমাদের দু’জনের কথা হয়। আমাদের সম্পর্ক এখন আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে। উনি উনার সারাদিনের গল্প করেন।

আমিও আমার অফিসে কেউ আমার সাথে হেসে হেসে কিংবা রেগে রেগে অথবা ভালবেসে কথা বলল এই সব ইতং বিতং শেয়ার করি। তবে এর মধ্যেও মাঝেমাঝে মিনমিন করে জানতে চাই লেখালেখির কি অবস্থা!

উনি টেনেটেনে বলেন, “হবে… হবে… ”

আমি “হাল ছেড়ো না বন্ধু আমার” এই পুরোনো বাক্যে নতুন করে উজ্জ্বিবিত হয়ে আশায় থাকতে থাকতে অপেক্ষার প্রহরকে দীর্ঘ থেকে আরো দীর্ঘায়িত করতে থাকি।

এই ভাবে দিন যায় মাস যায় আমাদের বন্ধ্ত্বু গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে।

তারপর হঠাৎ একদিন একটি ফোন এলো; ও লাজুক লাজুক স্বরে আমাকে জানাল অবশেষে ও লিখতে শুরু করেছে। প্রথম পাঠক হচ্ছি আমি। অবশ্য পাঠক না বলে শ্রোতা বলাই ভাল। যেহেতু ওর কাছ থেকে দূরে থাকি  তাই লেখাটা ও আমাকে ফোনে পড়ে শোনাল। আমি ওর লেখা শুনে যতটা আনন্দিত হলাম তার চেয়ে বেশী পুলকিত হলাম এই ভেবে যে, ও শুরু করেছে!  তারও চেয়ে বেশী অবাক হলাম এই কথাটা চিন্তা করে যে, চাইলে ছত্রিশবছরেও শুরু করা যায়। এখন শুধু লেগে থাকার পালা।

ইতিমধ্যে ওর হাতের নাগালে কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ চলে এসেছে। গাড়িও কেনা হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবী চলে এসেছে হাতের মুঠোতে।

ফেসবুক, টুইটার, মাইস্পেস, ইয়াহুম্যাসেঞ্জারে একাউন্ট খুলল ও। তৈরী হল অনেক দেশী বিদেশী বন্ধু। এমনি করে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচিত হল সমমনা আরো ক’জনের সাথে।

স্বপ্ন দেখতে শুরু করল আমার বন্ধুটি। যেহেতু সে নিজে নিজে বাইরে যেতে পারে না তাই অনলাইনের মাধ্যমেই একটি গ্রুপ খোলার চেষ্টা করল। যারা বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের বঞ্চনা, চাহিদা, সুযোগ সুবিধা আর অধিকারের বিষয়গুলো নিয়ে জনসচেতনতা তৈরী করার লক্ষ্যে কাজ করবে।

অনলাইনে কাজ করতে করতে গ্রুপে মেম্বার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল। গ্রুপের লোগো, ওয়েবসাইট তৈরী হল। এই ভাবে কাজে কাজে একটি বছর পেরিয়ে গেল।

প্রথম বছরপূর্তীতে সিদ্ধান্ত হল অনলাইনে যে সব সদস্যদের সহযোগীতায় আমার বন্ধুটি গ্রুপের কাজ এগিয়ে নিয়েছে; তাদের সবাইকে নিয়ে গেটটুগেদারের আয়োজন করা হবে। নির্দিষ্ট দিনে দূরদুরান্ত থেকে সবাই এলো। একজন আরেক জনের সাথে পরিচিত হল। এবং সেখানেই সবার মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হল শুধু মাত্র অনলাইনে গ্রুপের কাজ সীমাবদ্ধ না রেখে মাঠ পর্যায়েও কাজ করতে হবে। তাহলেই অনেক বেশী করে উপকৃত হবে সুবিধা বঞ্চিত মানুষ গুলো। যেই ভাবা সেই কাজ।

সদস্যদের ভিতর থেকে অনেকেই স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে মাঠ পর্যায়েও কাজ করতে এগিয়ে এলো।

তাদের নিয়ে আমার বন্ধুটি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আয়োজন করল  রচনা, বির্তক প্রতিযোগিতা, র‌্যালী,  মানববন্ধন, মুক্তালোচনা, জনমত গঠনে স্বাক্ষরতা সংগ্রহের কাজ।

বিতরণ করা হল লিফলেট  ছাপা হল  স্বরণিকা, পোস্টার। তৈরী করল তথ্যচিত্র।

সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রেডিও টিভিতে বিভিন্ন টকশোতে অংশগ্রহন করে জনমত গঠনে সোচ্চার ভূমিকা রাখল।

আর এই সব কাজের উদ্দেশ্য ছিল একটাই ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষগুলো যেন তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার সমাজের আর দশ জন মানুষের মতই পূরণ করতে পারে। তাদের জীবনের “না” গুলো যেন “হ্যাঁ” তে রূপান্তরিত হয়।

এতো পরিশ্রমের ফলাফলও পাওয়া যেতে লাগল আস্তে আস্তে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাসস্থান, কর্মস্থল, শপিংমল, যাদুঘর, স্টেডিয়ামে চলছে সিঁড়ির পাশাপাশি ঢালুরাস্তা বা র‌্যাম্প তৈরীর কাজ। যাতে যে কোনো ধরণের সহায়কদ্রব্য নিয়েও সহজে চলাচল করা যায়।

বাসগুলোতে কি করে র‌্যাম্প বসানো যায় সে ব্যাপারেও চলছে পরীক্ষা নিরীক্ষা।

আমাদের দেশে বিশেষচাহিদা সম্পন্ন মানুষদের জন্য ব্যবহারোপযোগী টয়লেট নেই; সে দিকেও মনোনিবেশ করা হচ্ছে।

বর্তমান ডিজিটাল যুগে আইটি সেক্টরে কি করে বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের প্রবেশোপযোগী করে গড়ে তোলা যায় সে বিষয়েও দেয়া হচ্ছে ওরিয়েন্টেসন, ট্রেনিং।

আর এই সব কিছুর পিছনে আমার বন্ধুটি অনলাইনে তৈরী হওয়া তার স্বেচ্ছাসেবী সদস্যদের নিয়ে টুকটুক করে এগিয়ে চলছে। বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের জন্য গড়ে তুলছে একটি সুন্দর আগামী।

যে মানুষটি কখনো চারদেয়ালের বাইরে পা বাড়ায়নি; বাড়ীর বাইরে কখনো কথা বলেনি – সে আজ কিনা করছে! দেশে বিদেশে আজ অনেকেই তাকে চেনে। ভাবা যায়? আমি আর কি বলব! নিজের চোখেই তো দেখছি!! চাইলে ছত্রিশ বছরেও শুরু করা যায়!

প্রয়োজন?  প্রয়োজন শুধু একটু অনুপ্রেরণা আর সহযোগীতা…

 

সেলিমা শারমীন ফারজানা রুমা

পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি)।

একীভূত সমাজ বিনির্মাণের অঙ্গীকার হৃদয়ে ধারণ করি

-তানজির ইসলাম বৃত্ত

আজ ৩ ডিসেম্বর, ২০১২ আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশ আজ এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করবে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় “একীভূত সমাজ বিনির্মাণে সংগবদ্ধ অঙ্গীকার”। প্রতি বছরের মত এ বছরেও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরাম এবং বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচী নিয়েছে। আয়োজন করেছে আলোচনা সভা, র‌্যালী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি।

১৯৯২ সাল থেকে  জাতিসংঘের আহ্বানে এ দিনটি আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে। নাগরিক অধিকার, বৈষম্যহীন সমাজ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি সম্মান, সমান সুযোগ, অংশগ্রহণের অধিকার এবং স্বাধীনতার প্রতি সম্মানের নীতিই এ দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য। প্রতিবন্ধিতা কোন রোগ কিংবা অসুখ নয়। বয়স, লিঙ্গ, জাতি, সংস্কৃতি বা সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী একজন মানুষ যা করতে পারে তা দৈহিক, মানসিক কিংবা ইন্দ্রিয়গত সীমাবদ্ধতার কারণে প্রাত্যহিক জীবনে করতে না পারার অবস্থাটাই হলো প্রতিবন্ধিতা। দৈহিক, মানসিক কিংবা ইন্দ্রিয়গত কার্যক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আংশিক, সম্পূর্ন কিংবা সাময়িক, চিরস্থায়ী হতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংক এর ২০১১ সালের জরীপে দেখা যায় পৃথিবীতে ১০০ কোটি ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষ আছেন। যা পৃথিবীর মূল জনসংখ্যার ১৫ ভাগ। সেই হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ২ কোটি ৪০ লাখ।

মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নের জন্য এ দেশে বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ বা অবকাঠামো তৈরি হয়নি এখনো। এ দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অসহায় নন, তাদের অসহায়ত্বের উপকরন হচ্ছে সামাজিক বাধা বা বৈষম্য। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সকল অধিকার ভোগ করার কথা থাকলেও, তা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে তাদের। পরিবার তাদের দূরে সরিয়ে রাখেন তথাকথিত সামাজিক মর্যাদা হারানোর ভয়ে। তারা বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন শিক্ষা, চাকরি, যাতায়াত, প্রবেশগম্যতা, স্বাস্থ্যসেবা, বিয়ে, প্রজনন সকল ক্ষেত্রে। সমাজিক ও পারিবারিক জীবনের সব ক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণে তারা সামাজিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য আলাদা কোটার ব্যবস্থা থাকলেও দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের জন্যে উন্মুক্ত নয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন একীভ’ত শিক্ষা পদ্ধতিতে পাঠদান। প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে দরকার সিড়ির পাশে র‌্যাম্প, সহায়ক টয়লেট, স্থান চিহ্নিত করতে ব্রেইল ব্লক, ইশারা ভাষার প্রয়োগ ইত্যাদি। এছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্রেইল ও ইশারা ভাষার প্রচলন  প্রয়োজন । কিন্তু বেশীরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এ সকল ব্যবস্থা নেই, ব্যাহত হচ্ছে তাদের প্রবেশগম্যতার সুযোগ। নিশ্চিত হচ্ছে না একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থা। তাই কোটা ব্যবস্থাটা প্রযোজ্য হচ্ছে না সকল শ্রেনীর প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য। প্রতিবন্ধী শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বিড়ম্বনার সম্মুখিন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদসহ শিশু অধিকার সনদ (১৯৮৯), বাংলাদেশ বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন (১৯৯০), প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদ (২০০৬) এবং সংশি¬ষ্ট অন্যান্য আইন ও নীতিমালাসমূহে সর্বজনীন শিক্ষার অধিকারের কথা বলা থাকলেও প্রতিবন্ধী শিশুরা শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিংবা অভিভাবকেরা বাধ সাধেন তাদের অসচেতনা কিংবা অজ্ঞতার কারণে। এছাড়াও বিদ্যালয় পরিবেশ প্রতিবন্ধীবান্ধব না হওয়ায় প্রতিবন্ধী শিশুটির অভিভাবক একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেন। এছাড়া সরকারি কিছু সিদ্ধান্তেও পরিলক্ষিত হয়। যেমন একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি শ্র“তিলেখকের মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে থাকেন। তিনি অতিরিক্ত সময় পেলেও একজন মাঝারি কিংবা মৃদু মাত্রার শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যারা নিজেরাই লিখতে পারেন তারা অতিরিক্ত সময় পান না যদিও তাদের জন্যে এই সময়টা অত্যন্ত প্রয়োজন। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে সকল শ্রেনীর পরীক্ষা শুরু হওয়ায় একজন শ্রুতিলেখক খুঁজে পাওয়া দূরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। যাতায়াত ব্যবস্থাতেও দূর্ভোগ পোহাতে হয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের। পাবলিক বাসে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকলেও তা কিছু অবিবেচক যাত্রীরা দখল করে রাখেন। হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীগণ উঠতে পারেন না সকল যানবাহনে। শুধুমাত্র সর্বজনীন প্রবেশগম্যতা না থাকার কারণে অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যেমন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তেমনি বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রেও সমান বাধার সম্মুখিন হচ্ছেন। অথচ ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ এ সর্বজনীন প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করার বিধান স্পষ্ট করা হয়েছে, যা মানা হচ্ছে না ভবন নির্মাণে। প্রতিবন্ধী বণক্তিদের একটা বড় অংশ দরিদ্র পরিবারের সদস্য। জীবনের একটা পর্যায়ে পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রতিবন্ধী সেই মানুষটিকে নামতে হয় জীবনের কঠিন যুদ্ধে। সামাজিক বাধা বিপত্তির ফলে অধিকাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে বেছে নিতে হয় ভিক্ষাবৃত্তি। কিছু কুচক্রী মহল জোরপূর্বক অনেক প্রতিবন্ধী শিশুর হাতে তুলে দেয় ভিক্ষার থালা। এ সকল অনিয়ম রোধে আইন থাকলেও নেই তার বাস্তব প্রয়োগ। সবচেয়ে বেশী সমস্যার স্বীকার হন নারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ। তাদের প্রতিবন্ধিতা  সাংসারিক জীবনে প্রবেশের পথে বাধা হয়ে দাড়ায়। অতিরিক্ত যৌতুক দিয়ে প্রতিবন্ধী মেয়ের বিয়ে দেন অভিভাবক। কিন্তু সাংসারিক সুখ অধরাই থেকে যায় তাদের। অনেকে হন নির্যাতিত বিশেষত বুদ্ধি, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী নারীগণ। কর্ম, যাতায়াত কিংবা শিক্ষা সকল ক্ষেত্রেই তারা আরও পিছিয়ে।

 

দেশের নাগরিক হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সামাজিক ও জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ২০০০ সালে জাতিসংঘের সম্মেলনে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য নির্ধারন করা হয়। এতে ৮ টি লক্ষ্য নির্ধারন করা হয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে যদি উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করা না যায় তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে সাফল্য লাভে আমরা পিছিয়ে পড়বো । যেমন -১.চরম দারিদ্র ও ক্ষুধাদূরীকরন ২. সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা ৩. নারী পুরুষের ক্ষমতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন ৪. শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস ৫. মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি ৬. টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতকরণ। সহস্রাব্দের উন্নয়নে লক্ষ পূরণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তাদের অবশ্যই মূল ধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ২৯ নং ধারায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমসুযোগ, সম-অংশগ্রহণ, সম-অধিকার রক্ষায় নির্দিষ্ট আইন রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কে আমানত গ্রহণ, ঋণ প্রদান ও ব্যাংক হিসাব খুলতে সহযোগিতা করাসহ সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা দিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া আছে। জাতীয় বাজেটে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রতিবছর অর্থ বরাদ্দ যে পরিমানে বৃদ্ধি করা হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য।

 

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দশক ২০০৩-২০১২ বিওয়াকো মিলেনিয়াম ফ্রেমওয়ার্ক ফর একশনের (বিএমএফ) ৭টি অগ্রাধিকারযোগ্য ক্ষেত্রকে গুরুত্ব ও বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সেগুলোও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে (১) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আত্ম সহায়ক সংগঠন, সংশি¬ষ্ট পরিবার ও অভিভাবকদের প্রতিষ্ঠার উন্নয়ন, (২) প্রতিবন্ধী নারী উন্নয়ন, (৩) সূচনায় শনাক্তকরণ দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শিক্ষা, (৪) আত্মকর্মসংস্থানসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান, (৫) নির্মাণ কাঠামোগত পরিবেশে প্রবেশগম্যতা ও সর্ব সাধারণের জন্য পরিবহন যান, (৬) তথ্য যোগাযোগ এবং সহায়ক প্রযুক্তিসহ যোগাযোগের প্রবেশগম্যতা ও (৭) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সক্ষমতা উন্নয়ন সামাজিক নিরাপত্তা এবং দীর্ঘস্থায়ী জীবিকা কর্মসূচির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন।

বাংলাদেশ ২০০১ সালে প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন পাশ করে যা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষায় একটি মাইলফলক। বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের সহযোগিতায় সিআরপিডির আদলে “বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আইন ২০১২” এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে যা এখন অনুমোদনের অপেক্ষায়। ২০১০ শিক্ষানীতিমালায় প্রথমবারের মত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একীভূত শিক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এছাড়া প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলাপমেন্ট প্রোগ্রাম (পিইডিপি২) তে প্রথমবারের মত শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। সরকারী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স¤পূর্ণ একীভ’ত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ এ প্রবেশগম্যতা বিষয়টির অন্তর্ভ’ক্তি আমাদের আশার আলো জাগাচ্ছে। জাতীয় তথ্যকোষে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক বিষয়বস্তু যুক্ত হয়েছে। আইসিটি পলিসি ২০০৯ এ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিশেষ চাহিদার স্বীকৃতি মিলেছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিভিন্ন অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়। এতকিছুর পরেও এখনো লক্ষ্য অর্জনে আমাদের পিছিয়ে থাকাটা রীতিমত হতাশাজনক। আইন থেকেও হচ্ছে না আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। অথচ বহি:বিশ্বে স্টিফেন হকিং কিংবা হেলেন কিলার এর কীর্তি সবাইকে অবাক করে। প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ পেলে উন্নত বিশ্বের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মতো আমাদের দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণও এগিয়ে যাবেন। সকল বাধা অতিক্রম করে প্রতিবছর ৯টি মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীনে প্রায় ২ লাখ ১৭ হাজার প্রতিবন্ধী এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। তাদের ভেতর অনেকেই আজ দেশের সর্ব্বোচ্চ বিদ্যাপিঠগুলোতে নিজের অবস্থান পাকা করেছেন। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে তাদের ভূমিকায় তারা প্রশংসার দাবিদার। বাংলাদেশের বুদ্ধি প্রতিবন্ধীরা বিশ্ব অলিম্পিকের শ্রেষ্ঠ পদক অর্জন করেছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একীভূত শিক্ষা, মাঠপর্যায়ে প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার ব্যবস্থা, যাতায়াতের সুব্যবস্থা, প্রতিটি ভবনে প্রবেশগম্যতার সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের অবশ্যই মূল ধারায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সমাজের বোঝা নন। তাদের প্রতি সকল বৈষম্যদূরীকরণে জাতিসংঘ সনদ (সিআরপিডি) বাস্তবায়ন জরুরী। এ ব্যাপারে সমাজ, রাষ্ট্র ও জনগণের সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় সুযোগ পেলে তারাও সমান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্যের চিহ্ন রাখতে পারেন।

সাবরিনা সুলতানা – বি-স্ক্যান প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি

তিনি বাংলাদেশের একজন ব্লগার । পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ ব্লগারদের মাঝে তিনি একজন যিনি ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে লিখতে ভালবাসেন। কিন্ত তিনি অন্য সকলের থেকে আলাদা কারণ তিনি লিখেন হৃদয় থেকে।

সত্যটা হলো তিনি অন্য সকলের মত লিখতে পারেন না, তিনি শুধু  ল্যাপটপের বোতামগুলো চাপতে পারেন তার কার্যক্ষম মাত্র দুটি আঙ্গুলে। কিন্তু তার হৃদয় অবিরাম স্পন্দিত হয়ে চলে লেখার মাধ্যমে নিজের ভাবনাগুলো প্রকাশের আকাংক্ষায়।

বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে সাবরিনার এই পথ চলা শুরু হয়। ১৯৯৮ সালে দৈনিক আজাদীতে তার প্রথম লেখা ছাপা হয় “স্বপ্ন কখনও সত্যি হয় না” শিরোনামে। যে মেয়েটি দু’বেনি দুলিয়ে দুষ্টুমী করে বেড়াতো সারা বাড়িময় তার সেই চঞ্চলতা থেমে গেল সাত বছর বয়সে মাস্কুলার ডিস্ট্রফী নামক ভয়ংকর রোগের আঘাতে। এই রোগ ধীরে ধীরে শরীরের সকল মাংসপেশীর কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। পঞ্চম শ্রেণীতে থাকাকালীন সময়ে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষকের পরামর্শে। বাবা মাও ভাবলেন ঘরে বসেই যা পারে শিখুক।

সাবরিনার প্রতিবন্ধিতাকে নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন করে তুললো। চারদেয়ালের মাঝে বন্দি হয়ে যেতে বাধ্য হলো। বন্ধ হয়ে গেল স্কুলে যাওয়া, সামাজিক মেলামেশা,  আত্মীয় স্বজনের বিয়ে বা কোন জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাওয়া। এই জীবনকেই মেনে নিয়েছিলো সাবরিনা স্বাভাবিক ভেবেই। কিন্তু কয়েক বছর না যেতেই ছোট বোনেরও একি রোগে আক্রান্ত হওয়া সাবরিনা মেনে নিতে পারেননি। প্রচন্ড হতাশা ও ক্ষোভ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন যা জাতীয় ও চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছিলো। ২০০৮ এর সে সময়টায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাইরের পৃথিবীর সাথে তার প্রথম যোগাযোগ। সোসাল নেটওয়ার্কিং এর জগৎ ফেসবুকে এসে নতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কার করলেন। ফেসবুকেই পরিচয় হলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন মানুষের সাথে। এই চিঠিটি এখানে প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে সচেতনত করতে শুরু করলেন। এ করতে গিয়ে ফেসবুকেই পরিচয় পোলিওতে আক্রান্ত সালমা মাহবুবের সাথে। মনে মনে এমন কাউকেই যেনো খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন স্বপ্ন পূরণের সাথী হিসেবে। মূলত এই চিঠিকে কেন্দ্র করেই ফেসবুকে ১৭ই জুলাই ২০০৯ এ গড়ে উঠে বাংলাদেশী সিস্টেমস চেঞ্জ এ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্ক (বি-স্ক্যান) একটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন। যার উদ্দেশ্য ছিল প্রতিবন্ধী মানুষ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরী করা এবং দৃষ্টিভংগী পরিবর্তন করা। ফেসবুকের পাশাপাশি তখন থেকেই ব্লগকে এই প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়া হয়। পত্রিকায় যেমন একটি লেখা দিলে সেটা ছাপতে প্রচুর সময় নেয় অন্যদিকে ব্লগে লেখা ছাপা হয়ে যায় ততক্ষনাৎ। তাই খুব সহজেই বি-স্ক্যান এর ভাবনাগুলো ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন মহলে। অনেকেই এগিয়ে আসেন একসাথে কাজ করা অঙ্গীকার নিয়ে। সাবরিনার লেখা এভাবে পৌছে যায় জার্মানীর সংবাদ সংস্থার আয়োজিত ডয়েচে ভ্যালে ব্লগ প্রতিযোগিতায়। তারা প্রতি বছর বিভিন্ন দেশের সেরা ব্লগারদের মাঝে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকেন। ২০১১ এর এ আয়োজনে বিচারকদের রায়ে মাত্র দু’ভোটের ব্যবধানে তিউনিসিয়ার ব্লগারের কাছে সাবরিনা পরাজিত হন।

সাবরিনার শারীরিক অবস্থা বর্তমানে আগের চেয়ে আরো খারাপ। লেখালেখিও তেমনভাবে আর করতে পারছেন না, তবে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার আদায়ের স্বপ্ন তিনি দেখে যাবেন আজীবন ।

বি-স্ক্যান প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক – সালমা মাহবুব

“একটি হুইলচেয়ারের অভাবে কারুর জীবন থেমে আছে, কারুরবা নেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা! সহায়ক চলাচলের ব্যবস্থা নেই বলে চার দেয়ালের আলো-আঁধারীতে কাটছে কারুর জীবন” এসব শুনলে নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না। সমাজে সর্বত্র প্রতিবন্ধী তথা ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তির অংশগ্রহণ এবং সর্বজনীন প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে যিনি সবসময়ই সোচ্চার। তাদের একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালগুলোতে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন- প্রচারণা চালানোসহ বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে র‌্যাম্প যুক্ত বাঁধা মুক্ত একটি সুন্দর অবকাঠামো তৈরীতে যিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন সেই মানুষটি নয় মাস বয়স থেকে দূরারোগ্য পোলিওর সাথে যুদ্ধ করছেন। যতটা না শারীরিক তারচে’ বহুগুণে সামাজিক এই যুদ্ধে জয়ী হবার সার্বক্ষনিক আপ্রাণ চেষ্টাগুলো ধরা পরে তার কার্যক্রমে।

পোলিওতে আক্রান্ত হবার পর মা-বাবা চিকিৎসার জন্যে অনেক জায়গায় ছুটোছুটি করেছেন। অনেক ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন কিন্তু পোলিও ভাল হয় না। দু’পা পোলিওতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে হাঁটার মতোন শারীরিক সক্ষমতা একেবারেই ছিলো না তার। যার ফলে জীবনের সিংহভাগ কেটে গেছে চারদেয়ালের মাঝে। ঘরের বাইরে যাওয়ার মত পরিবেশ বা সহায়ক ব্যবস্থাও তখন ছিল না বলে কখনো স্কুলের চেহারা দেখেননি তিনি। শুরু হলো ঘরে বসেই ‘অ’ ‘আ’ ‘ক’ ‘খ’ এর সাথে পরিচয়। বাবা মা একজন শিক্ষক নিযুক্ত করলেন তাঁদের একমাত্র কন্যা সালমা মাহবুবকে শিক্ষিত করে তোলার উদ্দেশ্যে। বাবা মায়ের ভালোবাসা ও ছোট দু’ভাইয়ের উৎসাহে ঘরে বসে যতটা সম্ভব পড়াশোনা করলেন। অনেক বছর পর প্রথম স্বাধীনতার হাতছানি নিয়ে ঘরে এলো একটি হুইলচেয়ার। কিছুদিন পরে ইন্টারনেটের ব্যবহার একরাশ সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিলো। পোলিও আক্রান্তদের সুখ-দুঃখের কথা জানতে এবং জানাতে ফেসবুকে একটি গ্রুপ খুললেন “পোলিও ভিকটিম”। ধীরে ধীরে অনলাইনে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘোরাঘুরি করে জানতে পারলেন বাইরের দেশগুলোতে প্রতিবন্ধী মানুষেরা বিভিন্ন ধরণের সহায়ক ব্যবস্থার সাহায্যে একেবারেই স্বাভাবিক মানুষের মতোন ঘরে বাইরে সর্বত্রই একা একা চলাফেরা করছেন। ছাত্র জীবন শেষ করে নিশ্চিন্তে কর্মজীবনে ঢুকে যাচ্ছেন। তাদের সম্বোধিত করা হয় “ভিন্নভাবে সক্ষম” নামে। যে সমস্তই আজো আমাদের দেশে এক সুন্দর স্বপ্নের মতোন।

সমাজের অবহেলিত মানুষদের জন্যে কিছু করার অনেকদিনের সুপ্ত বাসনা মাথাচারা দিয়ে উঠলো ফেসবুকে সাবরিনা সুলতানার সাথে পরিচয়ের পর। সাবরিনার আহ্ববানে সাড়া দিলেন তিনি, বিশেষত প্রধানমন্ত্রীকে লেখা সাবরিনার চিঠিটি অনুপ্রাণিত করেছে বেশি জনসচেতনতা মূলক এই কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। সাবরিনার চিঠিটি যেনো হুবুহু সালমার মনের কথা ছিলো। তিনি ভাবলেন এখন সময় এসেছে পরিবর্তনের। মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তনে কথা বলতে হবে। ঘরে বসে এ কাজ সম্ভব নয় বুঝেই ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন তিনি। প্রতিবন্ধী- অপ্রতিবন্ধী সমমনা মানুষদের একত্র করতে শুরু করলেন।

বর্তমানে তিনি বি-স্ক্যানের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপালনের পাশাপাশি জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের ‘ প্রবেশগম্যতা এবং সহায়ক প্রযুক্তি থিমেটিক গ্রুপ’ এর আহবায়ক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এই দেশকে প্রতিবন্ধী মানুষের বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে যাওয়াই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য এখন।

 

নিপুণ বেতের কারিগর ফটিকছড়ির রাসেল

নিজস্ব প্রতিবেদক: দুহাতের মাত্র ৬টি আঙুলের সাহায্য ও পায়ের গোড়ালি আর দাঁত দিয়েই কাজ করে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মুহাম্মদ রাসেল হয়ে উঠেছেন বেতের আসবাবের নিপুণ কারিগর। বাঁকানো দুটি পা নিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ হামাগুড়ি দিয়ে কারখানায় গিয়ে এই কাজ করেন তিনি। তবুও তার চোখে একটিই স্বপ্ন, নিজেই একদিন বেতের কারখানা খুলবেন। শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কাছে হার না মানা রাসেলের সেই স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে এল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বি-স্ক্যান।

গত ৩১ অক্টোবর ২০১৩ ‘প্রথম আলো’র সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র আলোকিত চট্টগ্রামে ‘প্রতিবন্ধী রাসেলের জীবন জয়’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি দেখে বাংলাদেশী সিস্টেমস চেঞ্জ এ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্ক (বি-স্ক্যান) উদ্যোগী হয়ে গত ১৬ জানুয়ারি, ২০১৪ তারিখে রাসেলকে ১০,০০০ (দশ হাজার) টাকা প্রদান করে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করার উদ্দেশ্যে।

বি-স্ক্যান এর একজন স্বেচ্ছাসেবক ফটিকছড়ি উপজেলার কাটিরহাটে সরেজমিন পরিদর্শনে জানতে পারেন, মাসিক ৩০০ টাকা প্রতিবন্ধী ভাতায় রাসেল সংসার চালাতে ব্যর্থ হয়ে পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতার উদ্দেশ্যে উপজেলার নাজিরহাটে বাজারে বেতের কাজ নেন। এই চাকরী করেই নিজে স্বাবলম্বী তো হয়েছেনই, ছোট বোনকেও পড়ালেখা করাচ্ছেন। যদিও নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পান নি। রাসেলের এই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যেই বি-স্ক্যান শুভাকাক্সক্ষী জনাব পাপিয়াস আহমেদের সহযোগিতায় এক অনাড়ম্বর আয়োজনের মাধ্যমে বি-স্ক্যান এর স্বনির্ভর প্রকল্পের আওতায় এই টাকা তুলে দেয়া হলে আনন্দে উচ্ছ্বসিত রাসেল জানান ‘দ্রুত তিনি নিজের ব্যবসা শুরু করার চেষ্টা করবেন। ভাই বোনকে আরো পড়ালেখা করিয়ে মানুষের মত মানুষ হিসেবে এ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে তুলবেন।’

নিপুণ বেতের কারিগর ফটিকছড়ির রাসেল

নিজস্ব প্রতিবেদক: দুহাতের মাত্র ৬টি আঙুলের সাহায্য ও পায়ের গোড়ালি আর দাঁত দিয়েই কাজ করে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মুহাম্মদ রাসেল হয়ে উঠেছেন বেতের আসবাবের নিপুণ কারিগর। বাঁকানো দুটি পা নিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ হামাগুড়ি দিয়ে কারখানায় গিয়ে এই কাজ করেন তিনি। তবুও তার চোখে একটিই স্বপ্ন, নিজেই একদিন বেতের কারখানা খুলবেন। শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কাছে হার না মানা রাসেলের সেই স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে এল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বি-স্ক্যান।

গত ৩১ অক্টোবর ২০১৩ ‘প্রথম আলো’র সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র আলোকিত চট্টগ্রামে ‘প্রতিবন্ধী রাসেলের জীবন জয়’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি দেখে বাংলাদেশী সিস্টেমস চেঞ্জ এ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্ক (বি-স্ক্যান) উদ্যোগী হয়ে গত ১৬ জানুয়ারি, ২০১৪ তারিখে রাসেলকে ১০,০০০ (দশ হাজার) টাকা প্রদান করে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করার উদ্দেশ্যে।

বি-স্ক্যান এর একজন স্বেচ্ছাসেবক ফটিকছড়ি উপজেলার কাটিরহাটে সরেজমিন পরিদর্শনে জানতে পারেন, মাসিক ৩০০ টাকা প্রতিবন্ধী ভাতায় রাসেল সংসার চালাতে ব্যর্থ হয়ে পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতার উদ্দেশ্যে উপজেলার নাজিরহাটে বাজারে বেতের কাজ নেন। এই চাকরী করেই নিজে স্বাবলম্বী তো হয়েছেনই, ছোট বোনকেও পড়ালেখা করাচ্ছেন। যদিও নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পান নি। রাসেলের এই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যেই বি-স্ক্যান শুভাকাঙ্ক্ষী জনাব পাপিয়া আহমেদের সহযোগিতায় এক অনাড়ম্বর আয়োজনের মাধ্যমে বি-স্ক্যান এর স্বনির্ভর প্রকল্পের আওতায় এই টাকা তুলে দেয়া হলে আনন্দে উচ্ছ্বসিত রাসেল জানান ‘দ্রুত তিনি নিজের ব্যবসা শুরু করার চেষ্টা করবেন। ভাই বোনকে আরো পড়ালেখা করিয়ে মানুষের মত মানুষ হিসেবে এ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে তুলবেন।’

প্রতিবন্ধী বান্ধব সমাজ বিনির্মান: গণ মাধ্যমের ভুমিকা

অদ্য ১৭ নভেম্বর ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে ভিপস্ “প্রতিবন্ধী বান্ধব সমাজ বিনির্মান: গন মাধ্যমের ভুমিকা” শীর্ষক এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাংলাদেশ ভিস্যুয়েলী ইম্পেয়ার্র্ড পিপলস সোসাইটি (ভিপস) এর উদ্যোগে ও সাইটসেভার্স এর সহায়তায় আয়োজিত এই সম্মেলনে স্বাগত ভাষণ প্রদান করেন ভিপসের সভাপতি জনাব মোঃ মোশারফ হোসেন ভূইয়া।  উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব নাছরিন বেগম মাননীয় অতিরিক্ত সচিব, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়; বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব আব্দুল মান্নান, মহাপরিচালক, রেজিষ্টার্ড, আইন মন্ত্রণালয় এবং জনাব জওয়াহেরুল ইসলাম মামুন, সভাপতি, সুইড বাংলাদেশ । উল্লেখিত নেতৃবৃন্দ এই সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দেন।  এছাড়া, বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকবৃন্দ, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধি, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবক, পেশাজীবী এনজিও প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে বক্তারা নিম্নোক্ত সুপারিশমালা প্রস্তাব করেন।

 

সুপারিশমালাঃ

কোন বিশেষ প্রতিযোগিতা বা বিশেষ অনুষ্ঠানের চেয়ে মূলধারার প্রতিভা অনুসন্ধান প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠানসমূহে অধিক মাত্রায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাফল্যগাথা আরও বেশি করে তুলে ধরতে হবে

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংস্থাসমূহের কার্যক্রম বেশি করে তুলে ধরতে হবে

গণমাধ্যমসমূহে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমস্যার পাশাপাশি ইতিবাচক দিক তুলে ধরতে হবে

প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক বিশেষ দিবসসমূহে সংবাদ প্রচারের পাশাপাশি বিশেষ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরকে অনুষ্ঠান নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে

বিশেষভাবে পারদর্শী লোকেদের জন্য কিছু করি

– অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী

একে কিভাবে দেখব? একে কি বলব – দুর্ভাগ্য নাকি দৈবদুর্ঘটনা? সমাজে আমাদেরই আত্বীয়স্বজন কেউ না কেউ এর শিকার – তাদের স্বাভাবিক জীবনে কোনো না কোনো প্রতিবন্ধকতার দেয়াল এসে দাঁড়িয়েছে। সমাজ তাদেরকে বলে প্রতিবন্ধী অথচ এতো কোনো অসুখ নয়, একটি অবস্থামাত্র। যারা এর শিকার তারা যতটা না নিজেদের পরিস্থিতির কারনে তারচেয়ে বেশি চারপাশের মানুষের নেতিবাচক মনোভাবের কারনে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। যারা এই পরিবেশকে সাহসের সাথে মোকাবেলা করেন তারাও কোনরকমে টিকে থাকেন, কিন্তু এদেশে তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম!

প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে মানুষ কমই জানে। অথচ যাদেরকে প্রতিবন্ধী বলা হয় তারাও কোনো না কোনোভাবে দক্ষ, বিশেষভাবে পারদর্শী। তাদেরও মেধা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা থাকে যা অনেক সময় সমাজের অনেক মানুষের চেয়ে বেশি। সমাজের মূলধারায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ঢোকাতে পারলে তাদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করলে, করুনা বা অনুকম্পার দৃষ্টিতে না দেখে সহমর্মিতার দৃষ্টিতে দেখলে দেশেরই লাভ হত।

মূলত অজ্ঞতার কারণেই এদেশের মানুষ ব্যক্তির আগে তার প্রতিবন্ধকতাকে দেখছে। তাই আসল পরিবর্তনটা দরকার দৃষ্টিভঙ্গিতে।

বাংলাদেশী সিস্টেমস চেঞ্জ এডভোকেসি নেটওয়ার্ক (বি-স্ক্যান) একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এর মুল লক্ষ্য প্রতিবন্ধী মানুযের মৌলিক অধিকার সম্বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। বাংলাদেশের আর দশজন মানুষের যতটুকু নাগরিক অধিকার তারচেয়ে অনেক কম নিয়ে তারা বেঁচে আছেন এবং প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন। আর তাই এই সংগঠনটি সকল ধরণের প্রতিবন্ধী মানুষের একীভ’ত শিক্ষা, সহায়ক যাতায়াত ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, সর্বক্ষেত্রে প্রবেশগম্যতা ও সামাজিক মর্যাদা আদায়ের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত লড়াই করছে।

প্রবেশগম্য ভবনের তৈরির লক্ষ্যে সভা সেমিনার করছে, আমাদের চোখ খুলে দিতে রিহ্যাব সহ সকল ইমারত নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিচ্ছে। একীভ’ত শিক্ষা ব্যবস্থার দাবীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে করছে গণস্বাক্ষর অভিযান। ‘ভেঙ্গে যাক সকল বাধা, তৈরী হোক চলাচলের সমতা’ এই স্লোগান নিয়ে বি-স্ক্যান তাই হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের সাথে নিয়ে র‌্যালী ও সমাবেশের আয়োজন করে সহায়ক যাতায়াত ব্যবস্থার দাবীতে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মূল ধারায় আনতে সচেতনতা সৃষ্টিতে তারা শর্ট ফিল্ম, ডকুমেন্টারি তৈরিসহ বেশ কিছু সফল আয়োজন করেছে বি-স্ক্যান। কিন্তু সমস্যা সমাধানে খুব বড় একটা অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয় না। সরকারসহ অনেকে এগিয়ে এসেছেন ব্যক্তি পর্যায়ে ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে। তবে বড় রকমের কোনো উদ্যোগ এখনো পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায় না। একটি প্রস্তুতিমূলক শুমারিতে জানা যায় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৯.০৭%  প্রতিবন্ধী। দেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠির এই বিশাল অংশটি এখনো অবহেলিত। তাদের জন্য শিক্ষার অধিকার এখনো অর্জিত হয়নি। বেশিরভাগ স্কুলেই এদেরকে যতœ নিয়ে মর্যাদা দিয়ে শিক্ষাদানের দৃষ্টিভঙ্গি নেই, সুযোগ সুবিধা যাও বা আছে তাও অনেক সীমিত। একীভ’ত শিক্ষা অর্থাৎ একি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অ-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সাথে পাল্লা দিয়ে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও অন্যান্য সব ধরণের প্রতিবন্ধী তথা ভিন্নভাবে সক্ষম শিক্ষার্থীগণ যেন নির্বিঘেœ পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে একে একীভ’ত শিক্ষা ব্যবস্থা পদ্ধতি বলে। আর এর জন্যে শুধু মাত্র সহায়ক কিছু ব্যবস্থার সাহায্য প্রয়োজন তাদের। শিক্ষিত হয়ে উঠলেই পাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ। আর একারণেই তো তারা বিশেষভাবে পারদর্শী বা ভিন্নভাবে সক্ষম।

কিন্তু বেশিরভাগ ইমারত ও দালানসমূহ প্রতিবন্ধীবান্ধব নয়। শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চলার পথের বাধা সিঁড়ি, কিন্তু ছোট একটি র‌্যা¤প বা ঢালু পথ সকলের জন্যে উন্মুক্ত। এমনকি ঘরের বাইরে গিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিশ্চিন্তে দীর্ঘক্ষণ অবস্থানের জন্যে কোথাও সহায়ক টয়লেট সুবিধা পর্যন্ত নেই। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্যে সিঁড়ির সাথে, ফুটপাথে, রাস্তায় কোথাও ব্রেইল ব্লক নেই। সকল নাগরিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। প্রতিবন্ধী আইনেরও সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই কোথাও, বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। শৈশব থেকেই তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যর শিকার। শিল্পোন্নত দেশসমূহে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দৈহিক, মানসিক ও আবেগগত ভাবে বেড়ে উঠার জন্য পরিবার তথা সমাজ থেকে সবিনয়ে যে অবলম্বন ও সাহায্য দেয়া হয় তেমন সাহস বা উৎসাহ নেই এদেশে তাদের জন্য। পারিবারিকভাবে অবহেলার শিকার হয় বলেই সমাজ থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকে তারা। এ বড় দুর্ভাগের ব্যাপার। এজন্য যে বিশাল আয়োজন প্রয়োজন তা নয়, মনের একটু আন্তরিকতা ও সহমর্মিতার উদ্যোগ হলেই যথেষ্ঠ।

আসুন তাই আমরা একসাথে কাজ করি ভিন্নভাবে সক্ষম এই লোকেদের জন্য। তারা আমাদের কারো না কারো পরিবারেরই একজন। তাদের প্রাপ্য অধিকার যেন তারা পায় এজন্য লড়াই করি। তাদের বাসযোগ্য একটি দেশ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হই।

ঝর্ণা মেশে সাগরে

শহিদুল আলম

গতরাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি। মিষ্টি একটা স্বপ্ন। কি মধুর এক অনাবিল অনুভুতি! একদম বের হতে ইচ্ছে করছিল না স্বপ্নটা থেকে…

একটি পাহাড়ের নিচে বেড়াচ্ছি। সাথে নুপুর, শাকিল, ময়না আর বিকাশ। আমার কলেজের সহপাঠী ওরা। পাহাড়ের গলা বেয়ে মিষ্টি, মধুর ছন্দ তুলে গড়িয়ে পড়ছে অপূর্ব একটি ঝর্ণা। কি অদ্ভুত সুন্দর সাদা ধবধবে তার ফেনারাশি। দুগ্ধফেনিল বোধ হয় একেই বলে। আমি চঞ্চল পায়ে ছুটে চললাম ঝর্ণার দিকে। ওদের হাত নেড়ে ডাকলাম – এই ময়না, নুপুর! আয়, জলদি আয়! দ্যাখ না কি সুন্দর!

যেন একটু দেরী করলেই এই পাহাড়, ঝর্ণা, সুন্দর প্রকৃতি সব মিলিয়ে যাবে কোন এক কালো জাদুর মন্ত্রবলে…

ছোটবেলা থেকেই খুব চটপটে আর চঞ্চল ছিলাম বলে আমার নাম রাখা হয়েছে ঝর্ণা। দৌড়ে অনেক পুরস্কার পেয়েছি স্কুলে। কেউ আমার সাথে পারত না। চাই ছেলে কি মেয়ে।

ত্রস্ত পদক্ষেপে আমি পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছলাম। এখন পরিষ্কার জলধারা স্পর্শ করতে পারছি। ওখানটায় একটা স্বচ্ছ জলাধার তৈরি হয়েছে। পাহাড়ের সবুজ, পীতবর্ণ মিশ্রিত বৃক্ষরাজির মধ্য থেকে নাম না জানা পাখির মিষ্টি কাকলি ভেসে আসছিল। পানিতে হাত দিলাম। ইশ, কি ঠাণ্ডা! কিন্তু ওরা কই? ওরা আসছে না কেন? ঘুরে ওদের ডাকতে গেলাম। কই ওরা? ওরা তো নেই! আবার ঝরনার দিকে ফিরে তাকাতেই সব মিলিয়ে গেল। স্বপ্ন গেল ভেঙ্গে…

ফিরে এলাম বাস্তবে। সামনে এল কঠিন, রুঢ় জীবন। মফস্বল শহরে আমাদের বাসাতে অনেক জুঝবার পর আমার অভিভাবকগণ আমায় এখানে নিয়ে এসেছেন। সিআরপি নামে একটি হাসপাতালে কোন এক ওয়ার্ডে শুয়ে আছি।

কিভাবে কি হল, আমি জানি না। গতদিনগুলো একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে। ছোট ভাইয়ের পিছে পিছে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে যাই। তারপরই হল এটা। প্রায় এক সপ্তাহের মত সবার বুঝতেই কেটে গেল আসলে কি হয়েছে। আমিও বুঝলাম না। বোঝার কোন চেষ্টাও করলাম না। শুধু বুঝলাম, আর কোনদিন ভাল হব না। আমার হাত-পা সব অচল হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে এখানে থাকলে নাকি হাতে কিছু জোর আসতে পারে।

কি হবে আমার? একে তো আমার মা-বাবা গরীব। তার উপর আমি মেয়ে। একজন বিকলাঙ্গ নারীর কিইই বা মূল্য এ সমাজে? সারা জীবন কি আমার অপরের গলগ্রহ হয়ে কাটাতে হবে? ধিক্কার দিলাম নিজেকে।  আর দেব নাই বা কেন? আমার এ অবস্থার জন্য কেউ তো আর দায়ী নয়। আমিই দায়ী। আর আমার ভাগ্য। আর কেউ নয়… কেউ না…। ছোট্ট একটা দুর্ঘটনা। তার খেসারত এত? এত বেশি? কি হবে আমার বেঁচে থেকে? আমি বাঁচব কার জন্য? কিসের জন্য?

এখানে সবাই বলছে, আমাকে নিজের জন্যই বাঁচতে হবে। আমার জীবনে নাকি এখনও অনেক কিছুই বাকি, আমার জীবন নাকি এখনও  অনেক দামী। অনেক দৃষ্টান্ত দেখায়। কত নামী দামী মানুষ! স্টিফেন হকিন্স বলে কে একজন আছেন, উনি নাকি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানি। কিন্তু আমার মনের জীবনের প্রতি আক্ষেপ, বিতৃষ্ণা কিছুতেই যায় না।

দিন কেটে যায়…।

এখানকার একজন আপু সোমা, আমার সাথে মাঝে সাঝে কথা বলতে আসতেন। হুইলচেয়ারে বসে আমাকে অনেক বোঝাতেন। কথাগুলো কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকত না। আপুরও নাকি এমনই সময় গেছে। এখন উনি এখানে একটা চাকুরী করেন। মন দিয়ে কাজ করেন। এই কাজই নাকি এখন তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।

খারাপ লাগাটা কিছুটা কমে এল। তবে পুরোপুরি গেল না। মা-বাবা আগে ফোন করতেন, এখন তাও কমিয়ে দিয়েছেন।

একদিন ওরা আমাকে হুইলচেয়ারে ওঠাল। বাইরে নিয়ে এল। অনেকদিন পর বাইরের প্রকৃতি, রোদ, গাছপালা দেখলাম। ভাল লাগল।

এরপর প্রায়ই আমাকে বাইরে আনা হত। তারই মধ্যে একদিন অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা হল। সোমা আপুই বললেন – চল, তোমাকে একটা জিনিষ দেখাই।

যেখানটায় গেলাম আমরা, ওখানে গাছপালায় ভরা ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়। সুন্দর স্নিগ্ধ সমীরণ। এক ভাইয়া ওখানে বসে ছবি আঁকছেন। তাও আবার মুখে একটা তুলি নিয়ে। কাছে গিয়ে দেখলাম, রং-তুলিতে ফুটে উঠেছে নিপুনভাবে গ্রামবাংলার সুনিবিড় সৌন্দর্য। গ্রাম্য মেয়েরা ঢেকি ভাঙ্গছে, খোপা বাঁধছে। সোমা আপু জানাল, ওঁর নাম সুভাস। একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ওঁর দুটো হাতই কেটে ফেলতে হয়েছে। ছবি আঁকা শিখে উনি জীবনের নূতন মানে খুজে পেয়েছেন। অভূতপূর্ব!

একটি সুখের আবেশ নিয়ে ওয়ার্ডে ফিরলাম। তারপর নিয়মিত সুভাসদার ছবি আঁকা দেখতে যেতাম। একদিন অবাক হয়ে দেখলাম, তাঁর তুলির আঁচড়ে একটি সুন্দর ঝর্ণা ফুটে উঠেছে। অনেকটা আমার স্বপ্নের সেই ঝর্ণার মতন। এ কিসের ইঙ্গিত? সৃষ্টিকর্তা কি আমায় কিছু বলতে চাইছেন?

একটা উপলব্ধি হল। সোমা আপু, সুভাসদা… এরাও জীবনে অনেক কিছুই হারিয়েছেন। কিন্তু ওঁরা তো হাল ছাড়েন নি। ওঁরা একটা কিছুতে জীবনের মানে খুজে পেয়েছেন। আমিও কি পেতে পারি না! আমিও তো মানবজাতিরই একজন। সবার মত না হোক, সবার মধ্যে থেকে আমার জীবনে এগিয়ে যাওয়া উচিৎ। ঠিক ঝর্ণার মত। ঝর্ণার জল নদীতে পড়ে স্রোতে রূপ নেয়। মিশে যায় অন্য জল, জলধারার সাথে। তারপর অন্তিমকালে সব কিছুই মিশে একাকার হয়ে যায় বিস্তৃত সাগরে।

আমারও চলতে হবে। বহু দূর। অনন্ত, অন্তিমের দিকে… সাগরে না মেশা পর্যন্ত।

আরও পরে একদিন আমার কলেজের বন্ধুরা চাঁদা তুলে আমার জন্য একটি অনন্য উপহার নিয়ে এল। একটি কম্পিউটার। আমি জীবনে এগিয়ে চলার একটি মানে খুজে পেলাম। তারপর… এগিয়ে চললাম…

Translate | অনুবাদ