বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির লড়াই পেরিয়ে ওরা তিনজন

শাহরিয়ার সাজ্জাদ

উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে ক্রমে ক্রমে পাহাড়সম সিঁড়ি পার করছে হৃদয় সরকার, রাজিয়া সুলতানা রুমকি ও দ্বীন মোহাম্মদ। পরিবারের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় তিনজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে পা রাখলেন এ বছর। শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী হৃদয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, রুমকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী দ্বীন মোহাম্মদ নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন।

হৃদয় ও রুমকির বাধা ডিঙানোর গল্প প্রায় একই হলেও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী দ্বীন মোহাম্মদের ভর্তি জটিলতা একবারেই ভিন্ন। বাংলা ইশারা ভাষায় পাঠদান এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাসহায়ক পরিবেশ সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই। ফলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা পা রাখার কথা ভাবতেই পারেন না। যদিও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন দ্বীন মোহাম্মদ।

মায়ের অনুপ্রেরণায় শুরুটা হলেও অনেকটাই নিজের কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলে মাধ্যমিকে জিপিএ ফাইভ ও উচ্চমাধ্যমিকে এ গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীকালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ ভর্তি পরীক্ষা দিলে ক, খ ও গ ইউনিটে যথাক্রমে ৪র্থ, ৩য় ও ১ম স্থান অর্জন করে ভর্তি হতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গড়িমসি শুরু করে। তার ভর্তি হওয়া নিয়ে দেখা দেয় সংশয়। আবেদন পত্র জমা দেওয়া সংক্রান্ত জটিলতায় কেটে যায় তিন মাসে। দ্বীন মোহাম্মদ অনেকটা বাধ্য হয়েই জেলা প্রশাসককে চিঠি দেন। জেলা প্রশাসক উপাচার্যকে ভর্তি করার অনুরোধ করলে তিনি জানান, তার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো কোটা নেই তাই তিনি কিছু করতে পারছেন না। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে দৃষ্টি, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের কোটার বিষয়ে উল্লেখ ছিল।

পরবর্তীতে দ্বীন মোহাম্মদ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরলে প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ (পিএনএসপি)’র প্রতিনিধি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে সংরক্ষিত কোটাসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিষয়ক আইন ও নীতিমালার উল্লেখ করলে তিনি এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন না বলে জানান এবং দ্বীন মোহাম্মদকে ডেকে পাঠান। পিএনএসপি থেকে যোগাযোগের বিষয়টি সমন্বয় করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই পর্যায়ে তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ফার্মাসিতে ভর্তি হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করায় মনে সংশয় নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিজেও তার সাক্ষাৎকার নেন। পরে উপাচার্য ফার্মাসি বিভাগে তার ভর্তির ব্যাপারটি নিশ্চিত করেন। দ্বীনের কলেজ জীবনেও এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কিছুতেই তাকে বিজ্ঞান বিভাগ দেওয়া হবে না। পরে শিক্ষকদের হাতে পায়ে ধরে দ্বীন বিজ্ঞান বিভাগ পায় এবং ৪.৩৩ গ্রেড নিয়ে পাশ করে। দ্বীন নিজের অধ্যায়নের পাশাপাশি বর্তমানে নবম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণির ছাত্রদের পদার্থ বিজ্ঞান এবং রসায়ন বিষয়ে পাঠদান করে। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরে আত্মবিশ^াসী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দ্বীন ভাবছেন স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানো আসলে অসম্ভব কিছু নয়।

অন্যদিকে হৃদয় ও রুমকির দুজনেই মায়ের কোলে চড়ে পার করেন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের সিঁড়ি। মায়ের কোলে চড়ে হৃদয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসার ছবিটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। ভর্তি কোটায় মস্তিষ্ক পক্ষাঘাত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো সুযোগ না থাকায় ভর্তিসংক্রান্ত জটিলতায় পড়তে হয় হৃদয়কে। অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী কোটার নীতিমালায় সংস্কার আনে কর্তৃপক্ষ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধিতাকে যুক্ত করে। হৃদয়ও ভর্তি হতে পারেন তার পছন্দের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হৃদয়ের ভর্তি জটিলতা সারা দেশে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। একই সময়ে শক্তিশালী মনোবল এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী কোটায় ভর্তি পরীক্ষা দেন রুমকি। কিন্তু ভর্তি হয়ে যাওয়ার পর বাধা হয়ে দাঁড়ায় কর্তৃপক্ষের অসহযোগী মনোভাব, প্রবেশগম্যতা এবং সংগতিপূর্ণ বন্দোবস্তের অভাব।

রুমকি ২০১৮-১৯ বর্ষে উর্দু ভাষা বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে তাকে আরবি বিভাগে স্থানান্তর করা হয়। শহীদুল্লাহ্ ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় এ বিভাগের পাঠদান করা হয়। কিন্তু মায়ের কোলে চড়ে প্রতিদিন ওপর-নিচ ওঠানামা মা মেয়ে দুজনের জন্য দুঃসাধ্য। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে একই ভবনের নিচতলায় ইতিহাস বা বাংলা বিভাগে ভর্তির অনুরোধ জানান রুমকি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। এরপর রুমকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনসমূহের নেটওয়ার্ক পিএনএসপি প্রতিনিধি জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক রুমকিকে ডেকে পাঠান এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যকে সংগতিপূর্ণ বন্দোবস্ত বিবেচনায় নিয়ে রুমকিকে নিচতলার শ্রেণিকক্ষে স্থানান্তরের অনুরোধ জানান। বর্তমানে রুমকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে (নিচতলা)অধ্যয়নরত।

স্বপ্নযাত্রায় উনিশ বছর

বিদঘুটে স্বপ্ন ভেঙে গেলে স্বপ্ন ভেবে যে প্রশান্তির ছায়া নেমে আসে তা আসেনি আশরাফুন নাহার মিষ্টির জীবনে। তবু এমনই সব ছোট ছোট বিদঘুটে স্বপ্ন নিজেকে ভেঙে দেওয়ার আগেই তিনি আবার বাঁধতে শুরু করেন নতুন স্বপ্নের ঘর-দুয়োর। এভাবেই নানা বাধা পেরিয়ে প্রতিবন্ধী নারীদের জীবনমান পরিবর্তনে তার দৃপ্ত পদচারণা আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। নির্যাতিত, নিপীড়িত প্রান্তিক প্রতিবন্ধী নারীদের অবস্থা পরিবর্তনে ছুটে চলেছেন প্রান্তর থেকে প্রান্তরে।
বাধা-বিপত্তির মধ্যেই মিষ্টি স্বপ্ন দেখেন ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনসমূহের সক্রিয় ভূমিকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব পরিবর্তন সম্ভব। অপরাজেয়-এর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় উঠে এসেছে স্বপ্ন বাস্তবায়নে মিষ্টির জীবনযাত্রার কথকতা।

অপরাজেয় প্রতিবেদক

আশরাফুন নাহার মিষ্টির জন্ম ১৯৭৭ সালে যশোর জেলায়। এগারো ভাইবোনের মধ্যে তিনি দশম। চৌদ্দ বছর বয়সে বাসার ছাদ থেকে পড়ে মেরুদন্ডে আঘাত পেলে বুকের নিচের অংশ অবশ হয়ে যায় তার। চিকিৎসকের পরামর্শে কিশোর বেলাতেই বসে পড়েন হুইলচেয়ারে। তবে পৃথিবীকে জানার অদম্য স্পৃহা তাকে হুইলচেয়ারের চাকায় গড়াতে শক্তি জুগিয়েছে প্রতিনিয়ত।

যদিও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতাগুলো তখনো বুঝে উঠতে পারেননি মিষ্টি। তাই প্রতি পদে হোঁচট খেয়েছেন। আবার নতুন করে উঠে দাঁড়িয়েছেন। উচ্চমাধ্যমিকে থাকাকালীন প্রথম লক্ষ করেন হুইলচেয়ারে চলাচল অনেক বড় একটি সমস্যা। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিকে ভালো ফলের কারণে উচ্চমাধ্যমিকের সময় কলেজ কর্তৃপক্ষ তার শ্রেণির পাঠদান প্রক্রিয়া দোতলা থেকে ভবনের নিচতলায় করার ব্যবস্থা করে। যশোরের স্থানীয় কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়তে পড়তেই স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় প্রবেশের। কিন্তু চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ এবং ইডেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও মৌখিক পরীক্ষায় হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী হওয়ার অভিযোগে ঝরে পড়েন মিষ্টি। হাল ছাড়েননি তবু। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। মিষ্টির বাবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বোঝানোর জন্য তার আরেক ভাইয়ের উদাহরণ দেন, যিনি হুইলচেয়ার ব্যবহার করেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেছেন। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারার ক্ষোভে বাণিজ্য বিভাগ নিয়ে ভর্তি হন যশোরের স্থানীয় কলেজে। ডিগ্রি পাস করার পর কাঁটাবন এলাকার একটি সিএ ফার্মে সুযোগ পান। কিন্তু হোস্টেলগুলোতে প্রবেশগম্যতা না থাকা বিশেষত প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি হোস্টেল কর্তৃপক্ষের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বাবা রাজি হলেন না। এরপর মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে হিসাবরক্ষণ বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন। প্রিলিতে নবম এবং ফাইনালে প্রথম স্থান অর্জন করে মাস্টার্স পাস করেন তিনি।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক প্রভাব এবং কর্মক্ষেত্রে প্রবেশগম্যতার অভাব ধীরে ধীরে আরও স্পষ্ট হতে থাকে। বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও মৌখিক পরীক্ষা থেকে বাদ পড়েন হুইলচেয়ার ব্যবহারের কারণে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় হুইলচেয়ার নিয়ে চলাচলে সমস্যা। ভবনের সামনে সিঁড়ি বড় ধরনের বাধা। ভেতরে প্রবেশগম্য টয়লেট থাকে না। এ সমস্যা ছাড়াও কর্তৃপক্ষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানই তাকে চাকরিতে নিতে অস্বীকার করেন। এমনকি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কর্মরত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করলে তারাও হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী নারী হওয়ার কারণে অসম্মতি জানায়। বিষয়টি মিষ্টিকে আঘাত করে। পরবর্তীতে ২০০১ সালে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থায় (বিপিকেএস) চাকরি পেয়ে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি।

উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন যেমন মিষ্টিকে চার দেয়ালের গন্ডিতে আবদ্ধ করতে পারেনি, তেমনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মিষ্টি নানান বাধাকেই শক্তিতে পরিণত করেছেন। নিজের জীবনের প্রতি মুহূর্ত দিয়ে অনুধাবন করেছেন এ দেশের প্রতিবন্ধী নারীর অবস্থান। তৃণমূলে প্রতিবন্ধী নারীদের কণ্ঠস্বর জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরতে প্রতিবন্ধী নারীদের সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন মিষ্টি সে সময়। কর্মজীবনের দুই বছর পর থেকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগোনোর প্রক্রিয়া শুরু করেন তিনি। শহরে ও তৃণমূলে কর্মজীবি এবং সাধারণ প্রতিবন্ধী নারীদের একত্র করে তাদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। বিপিকেএস এর উদ্যোগে ২০০৩ সালে শ খানেক প্রতিবন্ধী নারীর অংশগ্রহণে তিন দিনব্যাপী আয়োজিত এক সভায় তিনি লক্ষ করলেন, শহর ও গ্রামাঞ্চলে প্রতিবন্ধী নারীর অবস্থা একই। প্রতিবন্ধী নারীদের নিয়ে কর্মরত সংগঠন রয়েছে এবং তাদের যুক্ত করা হলেও অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ কোথাও নেই। কারণ, কোথাও তাদের কণ্ঠস্বর নেই। মূল সমস্যা হলো প্রতিবন্ধী নারী পরিবার ও সমাজ থেকে তেমন সহযোগিতা পায় না। আমাদের দেশে স্বাভাবিক সামাজিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী প্রতিবন্ধী পুরুষেরা ঘরে-বাইরে স্বচ্ছন্দে যে কারও সহযোগিতা নিতে পারে এবং পায়ও। সে তুলনায় প্রতিবন্ধী নারীরা নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অসহযোগিতার শিকার হয় বেশি। এখানেই প্রতিবন্ধী নারীর প্রতি মূল বৈষম্য ঘটে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী নারীদের নেতৃত্বে স্বাধীন সংগঠনের অভাববোধ থেকেই মিষ্টিসহ সাতজন শিক্ষিত প্রতিবন্ধী নারী ২০০৭ সালে গঠন করলেন উইমেন উইথ ডিসঅ্যাবিলিটি ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (ডব্লিউডিডিএফ)। তারা তৃণমূলে প্রতিবন্ধী নারীদের প্রতি বৈষম্য দূর করতে তিনটি ধাপে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমত জাতীয় পর্যায়ে জনওকালতি, দ্বিতীয়ত বিভিন্ন প্রতিবন্ধী নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা এবং তৃতীয়ত তৃণমূলে প্রতিবন্ধী নারীদের নেতৃত্বে দক্ষতা বৃদ্ধি ও অংশগ্রহণ, তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। এই সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন মিষ্টি। তারা আন্তর্জাতিক গ্লোবাল উইমেন কমিউনিকেশন (ডব্লিউআইডিএ) এবং গ্লোবাল ফাউন্ডেশন ফর ওম্যানসহ একসঙ্গে কাজ করছেন।

প্রতিবন্ধী নারীর ঘর থেকে বের না হওয়ার প্রবণতা কাটিয়ে তুলতে ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে কাজ করতে গিয়ে ডব্লিউডিডিএফ অনুধাবন করল, নির্যাতিত প্রতিবন্ধী নারীদের নিয়ে কাজ করা দরকার। আইনি প্রবেশগম্যতা নিয়ে জনওকালতি করতে গিয়ে খানিকটা প্রতিবন্ধী নারীদের বোঝাতে সক্ষম হন, চাইলে নিজেরাই আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন তারা। তবে পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা না থাকার ফলে আইনি সহায়তা দিতে গিয়ে প্রায় সময়ই আর্থিক সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় সংগঠনকে। কারণ, আইনি জটিলতায় মামলাগুলো দ্রুত ট্রাইব্যুনালে নেওয়ার কোনো উপায় না থাকায় বিচারের মাধ্যমে অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। প্রসঙ্গক্রমে মিষ্টি বলেন, প্রতিবন্ধী নারী ও শিশু নির্যাতন কেসগুলোকে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের আওতায় আনতে বিভিন্ন বার কাউন্সিলর এবং জজের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের খসড়া অনুমোদন পায় ২০০৩ সালে, তখন থেকেই প্রতিবন্ধী নারী ও শিশুর বিষয়ে এই আইনে আলাদাভাবে উল্লেখ রাখার জন্য আমরা জোর প্রচেষ্টা চালালেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে ব্যর্থ হয়েছি। তবে পূর্বের অভিজ্ঞতায় প্রতিবন্ধী নারীর নির্যাতনের কেসে থানা কোনো উদ্যোগ নিতে চাইত না। গুরুত্ব দিত না। দীর্ঘদিন এ নিয়ে কাজ করার ফলে অন্তত আমাদের কর্ম এলাকায় থানায় কোনো কেস নিয়ে গেলে এখন পুলিশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার, ওসিসি সেন্টারসহ সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম এবং কেন্দ্রগুলোতে প্রতিবন্ধী নারী ভুক্তভোগিদের সহায়তা সহজতর করার জন্য আমরা ২০০৬ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছি। আইনি প্রবেশগম্যতা নিয়ে ২০১৭-২০১৮ তে বগুড়া জেলায় কাজের বিষয়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী নারীর আইনের আশ্রয় নেওয়ার বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপারসহ আশপাশের থানাগুলোকে একত্র করে আমাদের বিভিন্ন জনওকালতিমূলক সভা হয় এবং এতে সচেতনতা বাড়ে। তবে নির্যাতিত প্রতিবন্ধী নারীর পুনর্বাসনের জন্য আরও বড় পরিসরে সরকারি পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করেন মিষ্টি। বিশেষ করে তৃণমূলের প্রতিবন্ধী নারীরা সরকারি সেবাগুলো সঠিকভাবে পাচ্ছে না।

এ জন্য প্রতিবন্ধী নারীর কণ্ঠ শক্তিশালী করতে তাদের সর্বস্তরে অংশগ্রহণ জোরালো করতে তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে প্রতিবন্ধী নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে ডব্লিউডিডিএফ থেকে উৎসাহ দেওয়া হয়। তবে প্রতিবন্ধী নারীদের ক্ষমতায়ন ও সমতাতে রয়েছে বিস্তর বৈষম্য। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে কিছুটা সচেতনতা বা প্রচেষ্টা দেখা গেলেও হচ্ছে না জাতীয় পর্যায়ে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে একজন প্রতিবন্ধী নারী মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে অপমানিত হন। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা, ২০১১-এর জাতীয় কর্মপরিকল্পনা’র খসড়া প্রণয়ন কমিটিতে সংসদে নারীদের সংরক্ষিত আসন সংক্রান্ত ধারা ৩২.৭ এ আলাদাভাবে প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য দুটি আসনের উল্লেখ আমরা নিশ্চিত করেছি। তবে এখন পর্যন্ত এই দুই আসনে প্রতিবন্ধী নারীর অংশগ্রহণ প্রক্রিয়ার ভেতরে না সরকার পৌঁছাতে পেরেছে, না প্রতিবন্ধী নারীরা পৌঁছাতে পেরেছে। তিনি জানান, পারিবারিক-সামাজিক চাপ ও ভীতি উপেক্ষা করে প্রতিবন্ধী নারী এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবে এই প্রত্যাশায় কাজ করে যাচ্ছে তার সংগঠন।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক ভিন্ন ভিন্ন এ ধরনের সমস্যাগুলো ২০০৮-২০১৮ পর্যন্ত নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ সনদ সিডও এবং ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) প্রতিবেদনে যা উঠে এসেছে, তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন মিষ্টি। প্রসঙ্গক্রমে তিনি আরও বলেন, সরকারের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বিষয়ক পরিকল্পনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয় উঠে আসছে অথচ তৃণমূলের নারীরা এসডিজি কী, সেটা এখন পর্যন্ত জানেন না। বিষয়গুলো অনেকটা প্রহসন যেমন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রেরিত জাতীয় স্বেচ্ছাপ্রণোদিত পর্যালোচনা (ভিএনআর) প্রতিবেদনেও প্রতিবন্ধী নারীর বিষয়টি একেবারেই আসেনি। সরকারের কাছে প্রতিবন্ধী নারীর বিষয়টি তাই আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

প্রবেশগম্যতা বিষয়ে মিষ্টি বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক ফোকাল মন্ত্রণালয় হিসেবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রত্যাশা অনেক। তাদের অবহেলার কারণেও সমষ্টিগতভাবে যেটুকু কাজ হওয়া দরকার, প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়ে তার এক শ ভাগের এক ভাগও কাজ হয়নি বলে মনে করেন তিনি। জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় সর্বজনীন প্রবেশগম্যতা বাধ্যতামূলক হলেও খোদ সচিবালয়ের অধিকাংশ ভবন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব নয়। র‌্যাম্প বা টেকটাইল ব্লকের ক্ষেত্রেও সঠিক নিয়ম মানা হচ্ছে না। হুইলচেয়ার প্রবেশগম্য একটি গণপরিবহনের জন্য বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের কাছে দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। কিন্তু তাতেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। সারা পৃথিবী বলছে
Leave NO One Behind বা কাউকে বাদ রেখে নয় কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখতে পাচ্ছি “Everyone is living behind who have disabilities ” বিশেষ করে আমাদের প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য সরকারের নিজস্ব কোনো উদ্যোগ নেই।

প্রতিবন্ধী নারীর উন্নয়নে আশরাফুন নাহার মিষ্টি কাটিয়ে দিয়েছেন উনিশটা বছর। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন উইমেন্স ফোরাম, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্মাননা। তিনি স্বপ্ন দেখেন সাধারণ মানুষের ইতিবাচক মনোভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে সমাজে আমূল পরিবর্তন আসবে। শিক্ষাঙ্গনে প্রতিবন্ধী কন্যাশিশুদের উপস্থিতি থাকবে চোখে পড়ার মতো। প্রতিবন্ধী নারীরা স্বাবলম্বী হবে। যাতায়াত ও অবকাঠামোগত ব্যবস্থায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ সর্বজনীন প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। নির্যাতিত প্রতিবন্ধী নারীরা আইনি সহায়তা পাবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনগুলোর সক্রিয় ভূমিকায় এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব।

বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সন্তানকে লুকিয়ে রাখা নিজের ক্ষতিসাধন

অপরাজেয় প্রতিবেদক

সেলিনা আক্তার রওশন চৌধুরীর চার সন্তানের দুজনেরই মধ্যে রয়েছে বহুমুখী প্রতিবন্ধিতা। নিজের সন্তানদের সঙ্গে জীবনসংগ্রামেই সেলিনা উপলব্ধি করেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা। প্রান্তিক পর্যায়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সচেতনতা তৈরি করতে শহর থেকে চল্লিশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে নিয়মিত যান চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলায়। সেখানেই ২০১০ সালে কয়েকজন প্রতিবন্ধী সন্তানের অভিভাবকদের নিয়ে গড়ে তোলেন চন্দনাইশ প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থা। সেলিনা আক্তার প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক।

সংগঠনটি যদিও প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে কিন্তু সেলিনা স্বপ্ন দেখেন, এ দেশের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মানুষেরা সাধারণের সঙ্গে মেলামেশা করবে। প্রাক্-প্রাথমিকের পাঠ শেষ করে সাধারণ বিদ্যালয়ে পড়বে। শুনতে অবাস্তব শোনালেও তার মতে অভিভাবকেরা একটু সচেষ্ট হলেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মানুষেরা সর্বস্তরে অংশগ্রহণ করতে পারে। তার মেয়ে দিলরুবা চৌধুরী এর জ্বলন্ত উদাহরণ।

সেলিনা তার বড় মেয়ে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী দিলরুবার প্রাক্-প্রাথমিক শেষে সাধারণ বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। বিশেষ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তীব্র নেতিবাচক মন্তব্যের মুখেও পড়েন সে সময়। তবে দিলরুবা মানবিক বিভাগ থেকে মাধ্যমিকে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ছোট মেয়ের বয়স সতেরো বছর হলেও বসতে কিংবা চলাফেরা করতে পারত না। দীর্ঘদিন চিকিৎসার ফলে বর্তমানে অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে।

সেলিনা চন্দনাইশ প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংগঠন থেকে প্রতিষ্ঠা করেন চন্দনাইশ প্রতিবন্ধী প্রাক্-প্রাথমিক বিদ্যালয়। যেখানে পঁচাত্তরজন নিবন্ধিত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী থাকলেও বর্তমানে পাঠ গ্রহণ করছে পনেরো থেকে বিশজন। বিদ্যালয়ে উপস্থিত না থাকার কারণ উল্লেখ করে সেলিনা বলেন, অনেক অভিভাবক আছেন যারা চায় না মানুষ জানুক তাদের সন্তানের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। অথচ এই বিষয়টি লুকিয়ে রেখে নিজেদের সন্তানের কতটা ক্ষতিসাধন করছেন, সে বিষয়ে তারা জ্ঞাত নন। তিনি একই বিষয়ে খানিকটা হতাশার সুরেই বললেন, অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতেই এতটা বছর কাটিয়ে দিলাম। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের তারা যেন ঘরের বাইরে বের করে, তার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করি। কিন্তু এত বছরেও পরিবর্তন করতে পারলাম না। এর জন্য প্রয়োজন সন্তানদের প্রতিবন্ধিতা নিশ্চিত করে অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া বললেন তিনি।

সেলিনা নিজের সন্তানদের প্রতিবন্ধিতা বুঝতে পারার পরে পরিবার ও সামাজিকভাবে নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। বর্তমানে সাংগঠনিকভাবে নিত্যনতুন বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাকে। যা কাটিয়ে উঠে নতুন উদ্যমে কাজ করে যাওয়াকেই চ্যালেঞ্জ মনে করেন তিনি। তাদের ফিজিওথেরাপি সেন্টারে প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে তিন শ প্রতিবন্ধী মানুষ মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে সেবা নেন। এ ছাড়া তারা স্থানীয় নিম্নবিত্ত ত্রিশজন প্রতিবন্ধী সন্তানের অভিভাবকদের নকশিকাঁথা ও সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। যাতে তারা সন্তানের চিকিৎসা, শিক্ষাসহ মৌলিক চাহিদাগুলোতে মেটাতে পারেন। সেলিনার সংগঠনের আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অপরাজেয়কে জানান, তাদের কার্যক্রম স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় চলে। তা ছাড়া সমাজসেবা অধিদফতর থেকে নিবন্ধন হওয়ায় তারা বার্ষিক কিছু অর্থ পান, যা পরিমাণে খুবই সীমিত। তিনি সরকারকে দায়বদ্ধতায় রেখে বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সব ক্ষেত্রে প্রবেশ করাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনগুলোর প্রতি সরকারকে সুনজর দিতে হবে। যাতে করে পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে না থাকে।

অগ্রযাত্রার পথে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী নারী বাস্কেটবল দল

অপরাজেয় প্রতিবেদক

বাংলাদেশের হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী নারী বাস্কেটবল খেলোয়াড়েরা প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক সিরিজ জয় করে এসেছেন। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত পঞ্চম বালি আন্তর্জাতিক হুইলচেয়ার বাস্কেটবল প্রতিযোগিতায় ৫-০ তে এই সিরিজ জয় করেন তারা।

ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেডক্রস (আইসিআরসি)-এর অর্থায়নে গত জুন, ২০১৮ তে বিশ দিনের বাছাই ক্যাম্পে নয়জন নারী খেলোয়াড়কে নির্বাচন করা হয়েছিল এই সিরিজের জন্য। বালি সাফল্যের পর আরও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ বছরের ২৩ মার্চ একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে থাইল্যান্ড সফরে যায় দলটি। আন্তর্জাতিক হুইলচেয়ার বাস্কেটবল ফেডারেশন ও এশিয়া ওশেনিয়া জোনের আয়োজনে সাত দিনব্যাপী এই প্রশিক্ষণ ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হবে থাইল্যান্ডের সুফান বুরির ন্যাশনাল প্যারালিম্পিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পটিতে এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী খেলোয়াড়দের বাস্কেটবলে দক্ষতা বৃদ্ধিতে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক দ্বারা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রশিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত জার্মান নারী দলের সাবেক কোচ হলগার গ্লিনিকি ও অস্ট্রেলিয়ান পুরুষ দলের হয়ে প্যারালিম্পিককে দুবার স্বর্ণপদক জয়ী  ট্রয় সাচ।

থাইল্যান্ডের এই প্রশিক্ষক দলের সঙ্গে আছেন বাংলাদেশের হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী নারী বাস্কেটবল দলনেতা মারজানা আক্তার। মেরুরজ্জে আঘাত পাওয়ার পর জীবনপথের গতি থমকে দাঁড়িয়ে ছিল। সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি) তে চিকিৎসা নিতে এসে যুক্ত হয়ে যান বাস্কেটবল দলে। এরপর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মারজানাকে। থাইল্যান্ডে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন দলের আরেক সদস্য শাকিলা মিতু। মারজানার মতো তিনিও ভাবেননি, প্রতিবন্ধী নারী হয়েও দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনতে পারবেন। মিতু সিআরপি তে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে চিকিৎসা নিতে এসে প্রথম হুইলচেয়ার বাস্কেটবল খেলা দেখেন। প্রথম দেখাতেই বাস্কেটবল খেলার সুপ্ত আশা সঞ্চার হয় তার মনে। পরের বছরই স্বপ্ন বাস্তবায়নের ডাক আসে সিআরপি থেকে। বাস্কেটবল দলে প্রশিক্ষণের জন্য তাকে নেওয়া হয়। রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলায় বেড়ে ওঠা মিতু ঢাকা শহরে হুইলচেয়ার নিয়ে একা বসবাস করতে পরিবারের বাধা ছিল। তাকে বেগ পেতে হয় সবাইকে মানিয়ে নিতে। অবশেষে সব বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে মিতু পনেরো জনের দলে এক মাসের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে সিআরপিতেই চাকরিতে যোগদান করেন এবং সময় পেলে বাস্কেটবল নিয়ে চলতে থাকে খুনসুটি। নেপালে ত্রিদেশীয় বাস্কেটবল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী নারী খেলোয়াড়েরা আন্তর্জাতিক আয়োজনে অংশ নেয়। বাছাইপর্ব থেকে মূল পর্বের জন্য নির্বাচিত হন মিতু। নেপালের প্রতিকুল আবহাওয়া সত্ত্বেও রানার্সআপ এবং ওম্যান অব দ্য ম্যাচের ট্রফি বাংলাদেশের ঘরেই নিয়ে আসেন মিতুরা। পরবর্তী সময়ে দেশে ফেরার পর বাংলাদেশ বাস্কেটবল ফেডারেশনের উদ্যোগে খেলোয়াড়দের সংবর্ধনা, সনদ ও প্রীতি ম্যাচ খেলার আয়োজন হয়। মিতু বলেন, দেশে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী নারী খেলোয়াড়ের সংখ্যা বেশি নেই এবং পর্যাপ্ত খেলারও সুযোগ নেই। সরকার যদি প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে ভবিষ্যতে প্রতিটি জেলায় আরও হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী নারী খেলোয়াড় তৈরি হবে এবং দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনবে তারাও।

গ্রামাঞ্চলে শোষণ, বঞ্চণা এবং নির্যাতনের মাত্রা বেশি

অপরাজেয় প্রতিবেদক

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র; কোথাও প্রতিবন্ধী নারীরা নিরাপদ নয়। গ্রামাঞ্চলের প্রতিবন্ধী নারীদের শোষণ, বঞ্চণা এবং নির্যাতনের মাত্রা অনেক বেশি। সরকারি নজরদারিতাও নেই বলেছিলেন রোকেয়া বেগম।

পনেরো বছর ধরে নরসিংদী সদর উপজেলায় কর্মরত শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী রোকেয়ার মতে পারিবারিক বাধা ও সমাজের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে প্রতিবন্ধী নারীদের মধ্যে জড়তাবোধ, নিজেকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা রয়েছে। ফলে দেখা যায় তাদের কারিগরি ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বাধা আসে এবং যোগ্যতার অভাবে উপযুক্ত কর্মসংস্থান বা মর্যাদাসম্পন্ন জীবনযাপনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তারা। অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে মজুরিবৈষম্য অনেক বড় একটি সমস্যা। নিজ অধিকার বা ন্যায্য প্রাপ্য চাইতে গেলে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয় নতুবা দারিদ্র্যের সুযোগে বা যেকোনো কারণেই পরিবার ও প্রভাবশালী ব্যক্তি দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া এটাই হলো আমাদের গ্রামাঞ্চলের প্রতিবন্ধী নারীদের অবস্থা।

রোকেয়া বেগম ১৯৭৬ সালে নরসিংদী সদর উপজেলার শীলামান্দি ইউনিয়নের বাগহাটা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রতিবন্ধী নারীদের শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তাসহ মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ২০০৩ সাল থেকে কাজ করছেন নিজ উপজেলায়। বর্তমানে সেবা প্রতিবন্ধী নারী পরিষদের সভানেত্রী, স্পন্দন প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক, প্রতিবন্ধী নারীদের জাতীয় পরিষদের সহ-সভাপতি, জাতীয় তৃণমূল প্রতিবন্ধী সংস্থার কার্যনির্বাহী পরিষদের মহিলা সম্পাদক হিসেবে তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ে সর্বত্রই তার পদচারণা।

একজন সংগঠক হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩-এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন বা প্রয়োগ না থাকাকে প্রতিবন্ধী নারীদের মর্যাদাকর জীবনের বড় বাধা বলে মনে করেন রোকেয়া। কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় বাধা ন্যায়বিচার না পাওয়া। প্রতিবন্ধী নারীরা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রসহ সব ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়। সব ক্ষেত্রেই তাদের মতামত উপেক্ষিত থাকে। আবার শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তাসহ মৌলিক মানবাধিকার বিষয়ে অধিকাংশ প্রতিবন্ধী নারী সচেতন নয়। তাই তার সংগঠন স্পন্দন প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থা তৃণমূলের প্রতিবন্ধী নারীদের সংগঠিত এবং আত্মনির্ভরশীল করে তোলার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, কাউন্সেলিং, আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে সম্পৃক্তকরণ, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আইনি সহযোগিতাপ্রাপ্তিতে যোগাযোগ স্থাপনসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ, আলোচনা ও কর্মশালায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়।

রোকেয়া বেগম অপরাজেয়কে জানান, শুরুটা এত সহজতর ছিল না। বিশেষত একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী হিসেবে ব্যক্তিগত জীবনে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে সহপাঠী ও শিক্ষকদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবারের অসহযোগিতা, স্বামী ও শ্বশুরবারির মানুষদের স্বার্থপরতামূলক আচরণ তার কর্মজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে। প্রতিমুহূর্তেই এ বাধা অতিক্রম করার চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। এই অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগিয়ে তিনি চান প্রত্যেক প্রতিবন্ধী নারীর জন্য নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে বৈষম্যপীড়িত প্রতিবন্ধী নারীদের কর্মসংস্থান, ন্যায়বিচার, প্রবেশগম্যতা ইত্যাদি বিষয়েও কাজ করতে চান। বিশেষত বিদ্যালয় ও হাসপাতালের অবকাঠামো ব্যবস্থা নিয়ে জনওকালতি করার পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি অবকাঠামো ও চিকিৎসাব্যবস্থা প্রতিকুল হওয়ায় প্রতিবন্ধী নারীদের সমন্বিত শিক্ষায় অংশগ্রহণ এবং সরকারি চিকিৎসা গ্রহণে বেগ পেতে হয়। তাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিবন্ধী নারী সংগঠনগুলোকেও আরও বেশি দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ আইনটি বাস্তবায়ন করতে সরকারি প্রতিষ্ঠানে জনওকালতির মাধ্যমে অধিকার অর্জনের কৌশল উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আইনটি সম্পর্কে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিজে ও তার পরিবার এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কার্যালয়সমূহ যথাযথভাবে অবগত নয়। তাই এ বিষয়ে অনেক প্রচারণা চালানো প্রয়োজন। প্রসঙ্গক্রমে সরকারি কর্মকর্তাদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, আইনে উল্লেখিত কমিটিসমূহ গঠন করা হলেও নিয়মমতো কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় না। এই আইনে গঠিত কমিটিতে বেসরকারি সদস্যদের একজন প্রতিবন্ধী নারী ও একজন প্রতিবন্ধী পুরুষ দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার কথা হলেও নরসিংদী উপজেলা কমিটিতে একজন স্বল্পদৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বেসরকারি সদস্য পদে রয়েছেন। নরসিংদী উপজেলার প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক মো. নাইম সরকার। এ ছাড়া সরকার প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, সে সম্পর্কে তৃণমূলের প্রতিবন্ধী নারীরা অবগত নন। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করতে এবং প্রতিবন্ধী নারীদের অংশগ্রহণ সন্তুষ্টিজনক করতে সরকারের কঠোর তত্ত্বাবধান প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

আত্মপরিচয়ের রাজনীতি ও প্রতিবন্ধী নারীর সংকট

নাজমা আরা বেগম পপি

বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে সাধারণ একজন নারীকে প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রমাণ করার যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। একজন পুরুষ ব্যর্থ হলে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করা হয়, কিন্তু একজন নারী ব্যর্থ হলে তাকে শুনতে হয় সে নারী বলেই পারেনি।

নারীকে তাই কাজ করতে হয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বাইরে সামাজিক চাপ মাথায় নিয়ে। তারপরেও আশাবাদী হয়ে বলতে চাই যে, অদৃশ্য এক চ্যালেঞ্জ নিয়েও আজ বহু নারী বিভিন্ন পেশায় কাজ করার সুযোগ তো পাচ্ছে! বেশি দিন আগে নয়, একটা সময় ছিল যখন পরিবার থেকেই নারীকে বাধার সম্মুখীন হতে হতো।

কিন্তু নারীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের ক্ষেত্রে কথাটি সত্য নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর শতকরা ১৫ ভাগ প্রতিবন্ধী মানুষ যা বাংলাদেশের জন্যও প্রযোজ্য। এ দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। সেই হিসাবে নারীদের ১৫ ভাগ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষ। নারীকে যদি পুরুষের তুলনায় অযোগ্য মনে করা হয়, তাহলে প্রতিবন্ধী নারীকে সমগ্র মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে অযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। আর দুঃখজনক হলেও সত্য, সমাজের ক্ষুদ্রতম পরিমন্ডল, নিজ পরিবারের মধ্য থেকেই তার মধ্যে এমন ধারণা প্রোথিত হয়। জ্ঞান বুদ্ধি হওয়া মাত্রই সে বুঝতে পারে এ বিশাল ধরণিতে সম্পূর্ণ উপযোগিতাহীন একজন মানুষ হিসেবে সে আর্বিভূত হয়েছে। যে দেশে রাষ্ট্রপ্রধান একজন নারী, সেখানে আজও সর্বসাধারণের কাছে একজন নারীর সক্ষমতার চুড়ান্ত মানদন্ড হচ্ছে স্বামী, সংসার, সন্তান প্রসব, লালন পালন করতে পারা। এ ছাড়া বাহ্যিক সৌন্দর্যের বিষয় তো রয়েছেই। পুঁজিবাদের বিজ্ঞাপন ও বিপণনের এই সময়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়া, পত্রিকা, বিলবোর্ডের আকর্ষণীয় নারীদের দেখে যেখানে একজন সাধারণ নারীই হীনমন্যতায় ভোগে, সেখানে একজন প্রতিবন্ধী নারীর মানসিক অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

সংকীর্ণ এক গলিতে, সমাজের নির্বোধ মানুষের বিদ্রুপ এড়িয়ে, লোকচক্ষুর অন্তরালে বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকাই যার নিয়তি। তাঁর পরিচয়, সে প্রতিবন্ধী মানুষ তায় আবার নারী তাই পরিবারের বোঝা সে।

একজন পরিণত মানুষের পরিচয় কীভাবে নির্ধারিত হয়? তার পরিবার, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা ইত্যাদি একজন ব্যক্তির পরিচয় বহন করে। আত্মবিশ্বাসী একজন ব্যক্তি নির্দ্বিধায় স্বীয় মতামত ব্যক্ত করতে পারেন এবং আত্মপরিচয়ে দীপ্ত একজন ব্যক্তি সঠিক মনে করলে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে ব্রত হন। এ ক্ষেত্রে তিনি সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, নিজের মতাদর্শে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হন। এভাবেই আসে পরিবর্তন, এভাবেই সৃষ্টি হয় নেতৃত্ব।

বাংলাদেশের সংবিধানে সকল নাগরিকের সম-অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইন করে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা যায় না। পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা থাকলে একজন প্রতিবন্ধী নারীও যে নিজ সক্ষমতার প্রমাণ রাখতে পারে, তার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। তবে সামগ্রিক বিচারে তা নগণ্য। প্রতিবন্ধী নারীকে আত্মপরিচয় লাভের সুযোগটুকু দেওয়া হোক। ফলাফলের চিন্তা না করে অন্তত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হোক। প্রতিযোগিতায় নাম লেখানোর আগেই আমরা তাদের ওপর ‘ডিসকোয়ালিফাইড’ তকমা যেন না লাগাই, এটুকু আশা করা কি খুব বেশি?  

সর্বস্তরে অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধী নারীর ক্ষমতায়ন

অপরাজেয় প্রতিবেদক

চার বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে দৃষ্টিশক্তি হারানো মহিমা বেগম আজ ভূমিহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়ছেন। বাল্যবিবাহ, যৌন নির্যাতন, যৌতুকের বিরুদ্ধে কাজ করছেন মাঠপর্যায়ে। তবে এই উঠে আসার লড়াইটা এত সহজ ছিল না বললেন মহিমা।

শিক্ষাজীবনের শুরুতেই মহিমাকে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ এক পথ। মিরপুর আইডিয়াল গার্লস থেকে মাধ্যমিক শেষে বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হতে গেলে অধ্যক্ষ প্রথম দিকে তাকে ভর্তি নিতে অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকেই উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে মহিমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে পড়তে শুরু করলেন। কিন্তু হলে থাকতে চাইলে প্রতিবন্ধী নারী হিসেবে আবার বাধার সম্মুখে পড়েন। হলের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয় মহিমাকে। তিনিও ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নন। রোকেয়া হলে থাকার ব্যবস্থা করেই তবে দম নিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে ২০১০-১১ সালের দিকে তিনি ব্র্যাকের ব্রেইল শিক্ষকের পদে আবেদন করেন। তবে তারা কোনো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নেননি। এতে তিনি মানসিকভাবে বেশ আঘাত পান।

এরপর মহিমা গ্রামের দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া মানুষদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছেতেই নিজেরা করি সংগঠনে কর্মজীবন শুরু করেন। বর্তমানে তিনি কুমিল্লা চান্দিনা উপজেলায় নিজেরা করি এর কর্মসূচি সংগঠক হিসেবে কর্মরত আছেন। মহিমা তার সংগঠনের হয়ে ত্রিশটি গ্রামে তিন শত আটষট্টিটি দল গঠনে কাজ করেন। এই দলে এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্যসহ স্থানীয়দের যুক্ত করা হয়। স্থানীয়দের মধ্যে নেতৃত্ব গুণাবলি আছে যার, তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা বাল্যবিবাহ, যৌন নির্যাতন, যৌতুকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পরামর্শের ব্যবস্থা করেন। উঠোন বৈঠক করেন। সাধারণ নির্যাতিত নারীদের সচেতন করতে কর্মশালাও করেন।

মহিমা প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেন। পরিবার ও সমাজে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে ধারাবাহিক আন্দোলনের রূপ দিতে চান। তিনি গ্রামের প্রতিবন্ধী সন্তান জন্মানোর ভ্রান্ত ধারণা পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিবারে গিয়ে কারণ ব্যাখ্যা করেন এবং প্রতিবন্ধী সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে অনুপ্রেরণা দেন। গ্রাম কমিটি থেকে নির্ধারিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে উপবৃত্তি বা ভাতা পাওয়ার ব্যবস্থা করেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানালেন, সচেতনতার অভাবে গ্রামে প্রতিবন্ধী মানুষেরা কী ভীষণ অবহেলায় দিনাতিপাত করছেন। তার পাশের গ্রামের একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধী মেয়েকে তার পরিবারই মানুষের মর্যাদা দিতে চায় না। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক তার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়েকে কারও সাথে মিশতে দেন না এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখেন। এ প্রসঙ্গে মহিমা বলেন, শিক্ষিত মানুষ এমন অসচেতন কার্মকান্ড করলে অশিক্ষিত মানুষের জন্য তা অস্বাভাবিক নয়। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি পরিবার ও সমাজের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি একই রকম নয়। তাই আমাদের মতো প্রতিবন্ধী মানুষের উচিত নিজেদের অধিকারগুলো বুঝে নেওয়া। যদিও বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাটা অনেকাংশেই কমে যাচ্ছে। তার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সরাসরি অংশগ্রহণের ফলস্বরূপ এই পরিবর্তন।

মহিমা বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সর্বত্র সরাসরি অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। প্রতিবন্ধিতা বরণ করার পর মহিমার পরিবারও তাকে নিয়ে চিন্তিত ছিল। তিনি তার পরিবারের সঙ্গে লড়াই করে বিদ্যালয়ে যান এবং পড়াশোনা শেষ করেন। যার ফলে এখন পরিবারে অনেকেই উৎসাহিত এবং ইতিবাচক। একেও তিনি একধরনের পরিবর্তন হিসেবেই মনে করেন।

সংগঠক ও নারী উদ্যোক্তা অ্যাড. নুরজাহান

অপরাজেয় প্রতিবেদক

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী সংগঠক ও উদ্যোক্তা অ্যাডভোকেট নুরজাহান। চট্টগ্রামের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি নুরজাহানের। তারপর নাসিরাবাদ মহিলা কলেজ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় কোটা সমস্যা এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাকে। স্নাতক শেষ করার পর আইনজীবী হিসেবে আদালতে চর্চা শুরু করতে আবারও বাধা। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নুরজাহান বলেন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের মামলায় লেখালেখিগুলো করতে হতো। আবার নানান বিষয়ে পড়ে পর্যালোচনা করতে হতো। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী শিক্ষানবিশ হিসেবে সে সময় আমি কোনো সহযোগিতা পাইনি। দেখেছি জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চান না। তাই এই পেশা থেকে নীরবে দূরে সরে এসেছি।

স্বপ্নের আইন পেশায় চর্চা করতে না পারায় এখন আর কোনো হতাশা নেই নুরজাহানের জীবনে। প্রতিবন্ধী মানুষের সংগঠনে কাজ করার মধ্যে সব প্রশান্তি খুঁজে নিয়েছেন তিনি। চট্টগ্রামের ইউনাইট থিয়েটার ফর সোশ্যাল অ্যাকশনে (উৎস) ২০০৮ সালে কর্মজীবন শুরু করেন নুরজাহান। এখানে চাকরি করতে করতেই গড়ে তোলেন নিজের সংগঠন রাইট অ্যাকশন ফর ডিসঅ্যাবিলিটি (র‌্যাড)। বর্তমানে তিনি র‌্যাড-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। প্রায় সাড়ে তিন শ সদস্যের মাঝে ৮০ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষের (সাধারণ সদস্য) সমন্বয়ে গঠিত এই সংগঠনের ৯ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাহী কমিটিতে প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছেন ৫ জন, যারা প্রত্যেকেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সদস্য। সদস্যগণ নিজেরাই চাঁদা তুলে এবং গণ্যমান্য ব্যক্তি বা সংগঠনের সহযোগিতায় বিগত প্রায় সাত বছরে অবহেলিত ও বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনটি প্রতিবন্ধী শিশু, এতিম ও দুস্থ পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে। সাংগঠনিক বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি নকশি বাংলা নামে একটি বুটিক পরিচালনা করেন তিনি। নকশি বাংলায় যেসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়- সেলাই ও কাটিং, ব্লক বাটিক, কারচুপি, জারদৌসি, নকশি সেলাই, নকশি প্লাস্টিক ব্যাগ, পুঁতির শোপিস, পুঁতির ব্যাগ, বিউটিশিয়ান এবং বিভিন্ন ধরনের রান্নার প্রশিক্ষণ ইত্যাদি। প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় কম্পিউটার ও ব্রেইল শেখানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণার্থীদের দ্রব্যাদি বাজারজাত করার লক্ষ্যে রয়েছে র‌্যাড-এর নিজস্ব শোরুম। ফলে শিক্ষার্থীদের বেকার বসে থাকার সুযোগ নেই। প্রতিবন্ধী নারীরা এখানে কাজ শিখে অনেকেই স্বাধীনভাবে কাজ করছেন। ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও প্রতিবন্ধী নারীর জীবনে পরিবর্তন শুরু হয়েছে, তা এগিয়ে নিতে ভবিষতেও কাজ করে যেতে বদ্ধপরিকর নুরজাহান।

মুক্তিযোদ্ধার দেশপ্রেম আছে, আমার কি নেই?

আশীষ দেবনাথ

স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে কত হাজারো নাগরিক যুদ্ধ করেছিল, আর কত লাখো নাগরিক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের যোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছিল, আজ হয়তো কেউ সঠিকভাবে বলতে পারবেনা। আমরা যদি একটু হিসাব মেলাতে চাই, তাহলে দেখতে পাই যুদ্ধক্ষেত্রে সেক্টর ছিল এগারোটি। এইএগারো সেক্টরে অসংখ্য যোদ্ধা জীবন বাজি রেখে লড়েছেন দেশের জন্য। বলা হয়, তিরিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের লাল-সবুজের পতাকা।নারীর সম্ভ্রম ও শহীদদের এই আত্মত্যাগ অবিস্মরণীয়।

কিন্তু অদ্ভুত এক উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ! কত বেশি বাঙালি সে সময় সরাসরি সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলেন, তা নিয়ে চলছে এক হাস্যকর খেলা। স্বাধীনতার পর কয়েক জন সেক্টর কমান্ডার ও সাব-সেক্টর কমান্ডারের প্রকাশিত বইয়ে নিয়মিত বাহিনীর ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর ১ লাখ ৭ হাজারসহ মোট ১ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হয়।কিন্তু আজ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিতে গেলে দেখা যাবে লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা এদেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। হাস্যকরভাবেই আরও আবেদন জমা পড়ছে। এ জমা পড়ার যেন শেষ নেই।অথচ অনেকেই আছেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু এখনো সনদ পাওয়া বহু দূরের ব্যাপার, আদতে তারা আবেদনই করেননি।

হাস্যকর হলেও সত্য, কারও দুর্নীতি নজরে আসা সত্ত্বেও তারা ছাড় পেয়ে যান।তাদের জন্য মন্ত্রণালয় হয়েছে। অধিদপ্তর হয়েছে। জেলাভিত্তিক সংসদ হয়েছে।চাকরির ক্ষেত্রে আলাদা করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশের স্থলে শতভাগ নিয়োগ নিতেও দ্বিধাবোধ হচ্ছেনা। হ্যাঁ, আমি মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলছি। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগের কথা বলছি।অথচ এদেশে বহু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, যারা সরকারি বিভিন্ন সুযোগ দূরে থাক, সনদই পাননি।অনেকে নিজেরাও সনদের মোহে লালায়িত নন। আবার অনেকে নিজ সন্তানের কোটা সুবিধা প্রাপ্তির জন্য বনেযান মুক্তিযোদ্ধা। আমার বাবাও একজন মুক্তিযোদ্ধা। হয়তো তার সনদ নেই কিন্তু আমি গর্ববোধ করি, আমি একজন খাঁটি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।

অন্যদিকে লাখো প্রতিবন্ধী মানুষ শিক্ষিত বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছেন।প্রতিবন্ধী কোটা থাকা সত্ত্বেও নেই নিয়োগের কোনো বাস্তবায়ন। নেই প্রতিবন্ধী মানুষের আলাদা কোনো অধিদফতর।নেই আলাদা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও কোনো প্রতিষ্ঠানে হচ্ছেনা তার বাস্তবায়ন।আমি নিজেই এর সাক্ষী। আমার লেখা দেখে এক পরীক্ষার্থী লিখিত পরীক্ষীয় উত্তীর্ণ হয়।আর আমার প্রতিবন্ধী কোটা থাকা সত্ত্বেও আমাকে উত্তীর্ণ হতে দেওয়া হয় নি। আমি আরও অনেক পরীক্ষা দিয়েছি, যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের লিখিত পরীক্ষায় মানবণ্টনের নির্বাচনীতে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয় এবং হয়েছে, যেখানে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ৫০ পেলেই মৌখিকের জন্য উত্তীর্ণ হয়ে যান, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাস মার্ক পেলেই হয়। সেখানে আমি ৬০ নম্বরের সঠিক লিখেও ঝরে পড়ি।আমার আত্মবিশ্বাস বলে কখনো কখনো আমি ৭০-এর বেশি উত্তর লিখে এসেছি কিন্তু মৌখিকের জন্য সুযোগ পাই না, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ডাক ঠিক পেয়ে যায়।

দেশ স্বাধীনের সময় সম্মুখ সমরে অংশ নিতে পারেননি তাই বলে কি প্রতিবন্ধী মানুষ অপরাধ করেছিলেন? আমি প্রশ্ন রাখতে চাই, একাত্তরে তিরিশ লাখ শহীদের মধ্যে কোনো প্রতিবন্ধী মানুষ কি নেই, যিনি হায়েনা পাকিস্তানিদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। প্রতিবন্ধী মানুষ কি এই দেশকে ভালোবাসেননা? প্রতিবন্ধী মানুষেরা কি এই দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশ তৈরিতে সারথি হতে পারেননা? একজন প্রতিবন্ধী মানুষ কি এই দেশকে তার সব প্রতিভা উৎসর্গ করার যোগ্যতা রাখেননা?

এই দেশে যদি এ মুহূর্তে কোনো যুদ্ধ লাগে, তাহলে আমি মনে করি শতভাগ প্রতিবন্ধী মানুষ তার ক্ষমতানুযায়ী ঝাঁপিয়ে পড়বে, যেখানে বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ পালিয়ে দেশ ছাড়বেন বা কেউ রাষ্ট্রদ্রোহে জড়িয়ে পড়বে। তাহলে আমাদের কেন এই দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া হচ্ছে? প্রতিটা কর্মক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকেরা তাদের কাজের পরিবেশই দিচ্ছেনা।কিন্তু আমি মনে করি, প্রতিবন্ধী মানুষ তার যোগ্যতা অনুযায়ী সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি সততার সঙ্গে কাজ করেন। এই দেশের সব খাতে সম-অংশগ্রহণের জন্য আইন, নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও মৌখিকে কেন লিখিততেই আমাদের কোটা দেখে বাতিল করে দেওয়া হয়।কোটার ব্যাপারে জানতে চাইলে পূরণ হয়ে গেছে বলে চেপে যাওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মতো আমার ভেতরেও দেশপ্রেম আছে, তার প্রমাণ আমি সরকারি বা বেসরকারি ঊর্ধ্বতনকে কীভাবে দেব?

জানি, এ সবে কিছু হবে না, তাই আমি চাই প্রতিবন্ধী মানুষের আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করা হোক।বিভাগ ভিত্তিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিদপ্তর থাকবে যেখানে প্রতিনিধিত্ব করব আমরাই।নিজেদের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারব।একারণেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিদপ্তর অনতিবিলম্বে দরকার, তাহলে আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান হবে।

বাড়ছে প্রতিবন্ধী নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি; হচ্ছে না সঠিক তদারকি

সুমনা খান

দেশে বিপুলসংখ্যক প্রতিবন্ধী নারী। যার অধিকাংশই রয়েছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহ, কমিউনিটি ক্লিনিক, প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান ব্যবস্থা থাকা সত্তেও সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রয়েছে আঁধারে।

প্রতিবন্ধী নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বিভিন্ন প্রকার আইন ও নীতিমালায় বিশেষ বিশেষ পদক্ষেপের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি, ২০১১-এর মূলনীতি ৩-এ স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত গরিব, প্রান্তিক, বয়স্ক, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী জনগণের অধিক গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া এবং এ লক্ষ্যে বিরাজমান সম্পদের প্রাধিকার, পুনর্বণ্টন ও সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। আবার কর্মকৌশল ৩১-এ মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী, বয়স্ক জনগোষ্ঠী, পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীসমূহের স্বাস্থ্যসেবার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার কথা উল্লেখিত রয়েছে। এ জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচির উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩-এর ১৬ ধারার ‘ট’ ও ‘ঠ’ উপধারায় প্রতিবন্ধী মানুষের সর্বাধিক মানের স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তির অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-এর লক্ষ্যমাত্রা ৩-এ সকল বয়সী সকল মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চয়তার বিষয়ে এবং লক্ষ্য ৩.৬ এবং ৩.৭-এ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও নারীর জন্য প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চয়তার উল্লেখ রয়েছে।

সরকার সকল জনগণ বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারীর মৌলিক স্বাস্থ্য সুবিধাসমূহ নিশ্চিত করতে বিশেষ স্বাস্থ্যকার্যক্রম এবং নীতিগত ও আইনি নির্দেশনা দিয়ে থাকলেও প্রতিবন্ধী নারীরা মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন। বিগত ও বর্তমান সময়ে নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও প্রতিবন্ধী নারীদের স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পারিবারিক ও সামাজিক সুরক্ষা ও সচেতনতা তৈরিতে পরিবার ও রাষ্ট্রের চরম অবহেলা লক্ষণীয়। প্রতিবন্ধী নারীর বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে হরমোনজনিত সমস্যা, দীর্ঘ একটানা কাজ করা, স্নায়ুগত সমস্যা, ঋতুকালীন স্বাস্থ্যসুরক্ষায় জটিলতা, স্তন ক্যানসার, মাতৃত্বকালীন পরিচর্চার অভাব ও আর্থ্রাইটিস।

সাধারণ স্বাস্থ্যসেবায় অপ্রতিবন্ধী নারীরা সেবা পেলেও প্রতিবন্ধী নারীর জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। উদাহরণস্বরূপ- কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী নারীর স্বাস্থ্য বা রক্ত পরীক্ষায় সাধারণ সুচের পরিবর্তে বাটারফ্লাই সুচ ব্যবহার করা প্রয়োজন, সে বিষয়ে সেবাপ্রদানকারী দায়িত্বশীলগণ সচেতন নন। আবার গুরুতর প্রতিবন্ধী নারীদের রক্ত পরীক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণত ধমনি খুঁজে পাওয়া যায় না, সে ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের অজানা। ফলে সাধারণভাবে রক্ত দিতে না পারায় ভুক্তভোগী হন প্রতিবন্ধী নারীরা। আমি নিজে একজন স্নায়ু জটিলতার সম্মুখীন শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী। অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা কোনোটাই আমার জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। আবার শব্দদূষণ, আলোর প্রভাব, টানা পরিশ্রম এগুলোও আমার জন্য অনুক‚ল নয়। স্নায়ুকেন্দ্রিক ব্যথার জন্য ডাক্তার দেখালে বাংলাদেশের ডাক্তাররা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ সমস্যার জন্য ঘুমের ওষুধ দেন, যা আমার জন্য প্রযোজ্য নয়। চিকিৎসকেরা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে জ্ঞান, প্রয়োজনীয় গবেষণা ও প্রশিক্ষণের অভাবে প্রতিবন্ধী নারীরা সুষ্ঠ স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি অবকাঠামোগত প্রবেশগম্যতার অভাব নারীর এই স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। এ বিষয়ে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী জাকিরা জেরিন তরী সন্তান প্রসবকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা নেওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা স্মরণ করে জানান তিনি ওয়ার্ডে ভর্তি-হয়েছিলেন। সিজার অপারেশন হয় তার। সন্তান প্রসব পরবর্তী প্রবেশগম্য টয়লেটের অভাবে তিনদিন নিদারুণ যন্ত্রণায় ভোগেন। কেবিন ব্লকে স্থানান্তরিত হতে চাইলে দরখাস্ত, বিশেষ অনুমোদন ইত্যাদি ছুটোঠুটি করে তবেই কেবিন পান। মাঝের সময়ে টয়লেট করতে বাসায় যেতে হয়েছিলো তাকে। কেবিনের টয়লেটে হাই কমোড থাকলেও দরজা ছোট হওয়ার কারণে হুইলচেয়ার নিয়ে প্রবেশে সমস্যা দেখা দেয়। পরে টয়লেট ব্যবহারের সময় দরজা খুলে রেখে যেতে হতো। অন্যদিকে মস্তিষ্ক পক্ষাঘাত, মাস্কুলার ডিসট্রফি, মায়োপ্যাথি, প্রতিবন্ধী নারীর জন্য নিউরো সায়েন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি বিশেষায়িত হলেও এ বিষয়ে তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নেই। এ সম্পর্কে মাস্কুলার ডিস্ট্রফি প্রতিবন্ধী নারী সুমাইয়া বিনতে শফি বলেন, আমাদের দেশে মাস্কুলার ডিস্ট্রফি সম্পর্কে কোনো গবেষণা ও অভিজ্ঞতা না থাকায় চিকিৎসকেরা এ ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষদের সাধারণ চিকিৎসাসেবা দিতে নানা ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হন। তাই তার মতো ভুক্তভোগীরা বঞ্চিত হন চিকিৎসাসেবা থেকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে চিকিৎসা সেবা পাওয়া প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা হলেও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী তাদের প্রাপ্তির অপ্রতুলতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আবার বিভিন্ন ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার সময় প্রবেশগম্য যন্ত্রাংশের কথা উল্লেখ করে পোলিওর কারণে দীর্ঘদিন থেকে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী সালমা মাহবুব বলেন, বিভিন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রে এক্স-রেসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশের উচ্চতা বেশি হওয়ায় সমস্যা হয়। আবার কিছু পরীক্ষা আছে, যেগুলো দাঁড়িয়ে করানো হয়, যা হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে অনেক বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি আবারও বলেন, বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের জন্য স্বাস্থ্যনীতি, ২০১১; প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অনুসরণে প্রতিবন্ধী নারীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে প্রতিবন্ধী নারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ কর্মসূচি প্রতিবন্ধী নারীবান্ধব করতে সহযোগিতা করবে। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এর এনডিসি কর্মসূচির সহকারী কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ডা. এস. এম. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০১১ স্বাস্থ্যনীতিতে প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়ে আমি অবগত নই। তবে ইতোমধ্যে প্রতিবন্ধিতার ধরণ সনাক্ত করতে ওয়াশিংটন গ্রুপ অন ডিসঅ্যাবেলিটি স্টাটিক্স এর ছয়টি প্রশ্নকে মূলভিত্তি ধরে আমাদের একটি সমীক্ষা কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এতে ডাক্তাররা পরীক্ষার মাধ্যমে ২০১৩ সালের সহায়িকা অনুযায়ী ব্যক্তির প্রতিবন্ধিতা সনাক্ত করবেন। এছাড়াও তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব টয়লেট নেই এমন পঁচিশটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ভবন চিহ্নিত করেছে। তবে নতুন নির্মাণাধীন হাসপাতাল ভবনসমূহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব করতে নির্দেশনা দেওয়া আছে। হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের দাঁড়িয়ে এক্স-রে সংক্রান্ত সমস্যা বিষয়ে এ প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে তারা এ বিষয়ে অবগত নন বলে তিনি জানান।

Translate | অনুবাদ