প্রতিবন্ধী মানুষের ঐক্য বাধা দরকার – মানিকগঞ্জ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা

অপরাজেয় প্রতিবেদক

চিকিৎসকের একটুখানি অবহেলায় সানজিদার আলো-ঝলমলে পৃথিবীটা হয়ে গেল আঁধারে ভরা। তাই বলে থেমে যাওয়ায় বিশ্বাসী ছিলেন না সানজিদা আলম নিজের আলোয় নিজেকে চিনিয়েছেন তিনি। বর্তমানে মানিকগঞ্জ জেলা শিক্ষা কার্যালয়ে সহকারী পরিদর্শক পদে ব্যস্ত জীবন কাটাচ্ছেন।

চার ভাইয়ের একমাত্র বোন সানজিদা। বাবার সেনাবাহিনীতে চাকরির সুবাদে বেড়ে ওঠেন দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার পথে পরিবারের বিশেষ কোনো সহযোগিতা পাননি তিনি। তবে যা করতে চেয়েছেন বাধাও পাননি তাতে। পথ সুগম করার দায়িত্বটা নিজের ঘাড়েই পড়েছিল। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় ভুল চিকিৎসায় দৃষ্টি হারান তিনি। দৃষ্টিশক্তিহীন মেয়েকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে চাইতেন না বাবা। পরবর্তীতে সানজিদার দৃঢ় উদ্যম এবং আশপাশের পরিচিত মানুষের সহযোগিতায় ভর্তি হন মিরপুর গার্লস আইডিয়াল বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে বদরুন্নেসা গার্লস কলেজে তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক এবং শিক্ষা বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলেন। এর মধ্যেই একদিন জানতে পেলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহকারী পরিদর্শক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কথা। আবেদন করেন এবং নির্বাচিত হয়ে যান।

সানজিদা তার এই সফলতার জন্য বন্ধুদের এবং প্রতিবন্ধী মানুষের সংগঠন অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছে বলে জানালেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কর্মরত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে তিনি চাকরি করেছেন। এ ছাড়া ভিজ্যুয়ালি ইম্পেয়র্ড পিপলস্ সোসাইটি (ভিপস)-এর সঙ্গে যুক্ত আছেন ২০১২ সাল থেকে।

সানজিদার মতে এদেশের রাস্তা, হাসপাতাল, বিদ্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব করতে সরকার যেটুকু পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে আমূল কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। সরকারি চাকরি পেতে প্রতিবন্ধী মানুষেরা ভুক্তভোগী হচ্ছে। তিনি নিজের উদাহরণ দিয়ে বলেন, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় ভালো ফল করলেও নিয়োগ নিয়ে পোহাতে হয় নানান ঝামেলা। প্রতিবন্ধিতা কোটায় নিয়োগের জন্য তাকেও মাস তিনেক ছোটাছুটি করতে হয়েছিল সমাজসেবা অধিদফতর এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এছাড়াও তিনি বললেন, তার কর্মস্থল প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সম্পূর্ণ প্রবেশগম্য নয়। ইমারত বিধিমালা মেনে কেউ ভবন তৈরি করে না। সরকারের এ বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পরিবহন ব্যবস্থাও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব নয়। যানবাহনগুলোতে নেই র‌্যাম্প, হুইলচেয়ার রাখার জায়গা, আবার যে কয়েকটা আসন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ থাকে, সেগুলো সম্পর্কেও কেউ সচেতন নন। চাকরির সুবাদে সানজিদাকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে যেতে হয়। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে খানিকটা ইতিবাচক পরিবর্তন থাকলেও অবকাঠামোগত সমস্যা এবং শ্রæতিলেখকসহ কিছু ভোগান্তি রয়েছে যা শিক্ষা অর্জনে বড় বাধা বলে তিনি মনে করেন। প্রতিটি জেলায় ন্যূনতম একটি বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বড় পরিসরে আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কাজ করা দরকার বললেন সানজিদা। এছাড়াও প্রতিবন্ধী শিশুর মানসিক দৃঢ়তা বৃদ্ধিতে পরিবারকে আরও বেশি দায়িত্বশীল হওয়ার তাগিদ দেন তিনি বলেন এতে শিশুটি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠবে। ঘরের বাইরে বের হবে। সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াবে। তবে আমলাতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সরকারের উচ্চপদস্থ ক্ষমতাসীনদের নেতিবাচক ধারণা ভাঙতে এবং কঠোর চাপ প্রয়োগ করতেই প্রতিবন্ধী মানুষদের ঐক্যবাধার আহবান করেন সানজিদা।

সিডও এবং জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ও কর্মপরিকল্পনা

অপরাজেয় ডেস্ক

নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ হিসেবে কনভেনশন অন দ্য ইলিমিনেশন অব অল ফর্ম অব ডিসক্রিমিনেশন অ্যাগেইনস্ট ওমেন ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ (সিডও) সনদটি কার্যকর হতে শুরু করে। বাংলাদেশ এই সনদে ১৯৮৪ সালে অনুস্বাক্ষর করে।

সিডও ধারা ১১-এর ১-এ পুরুষ ও নারীর সমতার ভিত্তিতে তাদের একই অধিকার, নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সর্ব প্রকার নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে শরিক রাষ্ট্রসমূহ নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণের জন্য সকল উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, বিশেষ করে নিম্নে বর্ণিত অধিকারসমূহ বাস্তবায়ন করবে

ক) সকল মানুষের অহস্তান্তরযোগ্য কর্মসংস্থানের অধিকার;

খ) কর্মে নিয়োগের ক্ষেত্রে একই বাছাই মান প্রয়োগসহ একই নিয়োগ সুবিধা পাওয়ার অধিকার;

গ) পেশা ও চাকরি স্বাধীনভাবে বেছে নেওয়ার অধিকার; পদোন্নতি, চাকরির নিরাপত্তা এবং চাকরির সকল সুবিধা ও শর্ত ভোগ করার অধিকার এবং শিক্ষানবিশ হিসেবে প্রশিক্ষণ, উচ্চতর বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, পুনঃপ্রশিক্ষণ গ্রহণের অধিকার;

ঘ) বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ সমান পারিশ্রমিক, একই মানের কাজের ক্ষেত্রে একই আচরণ, সেই সঙ্গে কাজের মান মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সমান আচরণ পাওয়ার অধিকার;

ঙ) বিশেষ করে অবসর গ্রহণ, বেকারত্ব, অসুস্থতা, অক্ষমতা ও বার্ধক্য এবং কাজ করার অন্যান্য অক্ষমতার ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার এবং সেই সঙ্গে সবেতন ছুটি ভোগের অধিকার;

চ) সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়া নিরাপদ রাখাসহ স্বাস্থ্য এবং কাজের পরিবেশে নিরাপত্তার অধিকার।

ধারা ১১-এর ২তে বিবাহ অথবা মাতৃত্বের কারণে নারীর প্রতি বৈষম্য রোধ এবং তাদের কাজ করার কার্যকর অধিকার বাস্তবায়ন করতে শরিক রাষ্ট্রকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে এবং এর বিভিন্ন উপধারায় উল্লিখিত আছে:

ক) গর্ভধারণ অথবা মাতৃত্ব সংক্রান্ত ছুটির কারণে বরখাস্ত এবং বৈবাহিক অবস্থার ভিত্তিতে বরখাস্ত করার ক্ষেত্রে বৈষম্য নিষিদ্ধ করা;

খ) বেতনসহ ছুটি অথবা পূর্বেকার চাকরি জ্যেষ্ঠতা অথবা সামাজিক ভাতাদি না হারিয়ে তুলনাযোগ্য সামাজিক সুবিধাদিসহ মাতৃত্ব সংক্রান্ত ছুটি প্রবর্তন করা;

গ) বিশেষ করে একটি শিশু পরিচর্যা সুবিধা নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের মাধ্যমে পিতা-মাতাদের তাদের কাজের দায়িত্বের সঙ্গে পারিবারিক দায়িত্ব সংযুক্ত করে নাগরিক জীবনে অংশগ্রহণে সক্ষম করে তোলার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সহায়ক সামাজিক সার্ভিসের ব্যবস্থা উৎসাহিত করা;

ঘ) গর্ভাবস্থায় যে ধরনের কাজ নারীর জন্য ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত, গর্ভকালে তাদেরকে সে ধরনের কাজ থেকে বিশেষভাবে রক্ষার ব্যবস্থা করা;

এবং ধারা ১১-এর ৩-এ নারী ও পুরুষের সম-অধিকার বাস্তবায়ন বিষয়াদি সম্পর্কে রক্ষামূলক আইন, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের আলোকে সময় সময় পর্যালোচনা করা হবে এবং প্রয়োজনমতো সংশোধন, বাতিল অথবা সম্প্রসারণ করা হবে।

যা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শরিক রাষ্ট্রসমূহ নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণের জন্য সব উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অন্যদিকে সিডো সনদের আলোকে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন, সমঅধিকার ও অধিকতর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির পক্ষে সমর্থন যোগাতে, তাদের অবদানকে সর্বক্ষেত্রে স্বীকৃতি দিতে নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ প্রণয়ন করা হয়। এই নীতি বাস্তবায়নে প্রণীত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৩ বর্তমান কর্মসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন ভবিষ্যত কর্মসূচির বিবরণ, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তা বাস্তবায়নের জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ও দায়িত্বপ্রাপ্ত রয়েছে। এই কর্মপরিকল্পনার বিভিন্ন ধারা উপধারাসমূহে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মধ্যে প্রতিবন্ধী নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে নানামুখি পদক্ষেপ গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে। প্রতিবন্ধী নারীদের স্বীকৃতি ও সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকার এবং শিক্ষাসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রতিবন্ধিতার ভিন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশনা রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি এই পরিকল্পনায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ৫% বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীবান্ধব বিদ্যালয় নির্মাণ, প্রতিবন্ধী নারীদের অর্থনৈতিক সুযোগ প্রদানের লক্ষ্যে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ গঠন, বিদ্যালয় এবং বয়ষ্ক শিক্ষা কেন্দ্রে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হার ৩% এ উন্নীতকরণসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রতিবন্ধী নারীদের বর্ধিতহারে নিয়োগ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এছাড়াও গুরুতর প্রতিবন্ধী নারী যারা সাধারণ শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না, শুধুমাত্র সেই নারীদের জন্য বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থা বিবেচনায় নেওয়ার উল্লেখ রয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে পর্যায়ক্রমে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ব্রেইল পদ্ধতি এবং বাংলা ইশারা ভাষা ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ এবং জনগণকে সচেতন এবং দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ৫% সিট সংরক্ষিত রাখা বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।

প্রসঙ্গ; প্রতিবন্ধী নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন

সালমা মাহবুব

জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণ খুব বেশি দিনের পুরোনো নয়। মূলত ১৯ শতকের শেষ থেকে নারীরা বিভিন্ন দেশে তাদের নির্বাচনে ভোটাধিকার অর্জন করতে শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ নারীদের ভোটের অধিকারকে উৎসাহিত করে এবং ১৯৭৯ সালে নারীর প্রতি সকল ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী ১৮৯টি দেশে তাদের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে সৌদি আরব এই সনদের তোয়াক্কা না করেই নারীদের ভোটাধিকার দেয়নি। যদিও ২০১৫ সালে তারা নারীদের ভোটাধিকার দিতে বাধ্য হন।

ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইউএন ওমেন এর এক জরিপে দেখা যায়, ১৯৯৫ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন দেশের সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব স্বতন্ত্র অথবা সংসদের নিম্ন কক্ষে আসন পাওয়ার হার ধারাবাহিকভাবে ১২ থেকে ২৩ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নারীর ক্ষমতায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ফলে বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়নে উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৮-এর সরাসরি ভোটে ২২ জন নারী সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। বিভিন্ন উচ্চ প্রশাসনিক পদে নারীদের নিযুক্ত করা হচ্ছে। সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাÐ সংক্রান্ত কমিটিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব ছাড়া আমরা এখন ভাবতে পারি না। কিন্তু এই কমিটি বা শুধু নারীকেন্দ্রিক কমিটিগুলোতেও প্রতিবন্ধী নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না। বরং তাদেরকে কল্যাণের দৃষ্টিতে দেখা হয়, যেমনটি আগে সকল নারীকেই দেখা হতো।

যদিও জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদের ধারা ৬-এ নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে এবং ধারা ২৯-এ প্রতিবন্ধী মানুষের রাজনৈতিক ও জনজীবনে অংশগ্রহণ, ভোট প্রদান এবং নির্বাচিত হওয়ার অধিকার ও সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু এই সনদের আলোকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ তৈরি হলেও এখানে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন তো দূরের কথা, প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য আলাদা করে কোনো কিছুই তেমনভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষ উভয়েরই সাংবিধানিকভাবে ভোট প্রদানেই রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী মানুষের ভোট দেওয়ার বিষয়ে এখনো আমাদের চিন্তাভাবনায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা প্রতিবন্ধী মানুষেরা নিজেরাই এখনো মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকারের বিষয়ে সচেতন নই। তারা নির্বাচনে ভোট দেবেন এবং প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেবেন, এটা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য। জেলখানার কয়েদিদের ভোটাধিকার প্রয়োগে যারা সোচ্চার, তারা মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী মানুষের বিরোধিতা করে বলেন, মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী মানুষ বুঝেশুনে ভোট দিতে পারবেন না, প্রতিনিধি হবেন কীভাবে! যদিও তাদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা মোটেও সহজ কাজ নয়। ভোট পাওয়ার জন্য ভোটারদের কাছে গিয়ে বোঝাতে হয়। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী মানুষেরাও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার অর্জন করতে পারেন। তবে তার জন্য প্রয়োজন সঠিক প্রশিক্ষণ। আমাদের দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধী মানুষের সম্পৃক্ততার বিষয়ে প্রশিক্ষণ কাঠামোতে পরিবর্তন আনলে এ বিষয়ে ভাল ফল পাওয়া যাবে।

যেহেতু সুরক্ষা আইনের ধারা ৩৬-এ বলা হচ্ছে, প্রতিবন্ধিতার কারণে কারও প্রতি বৈষম্য করা যাবে না। অন্যদিকে সিডও-এর ৭ ধারায় রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে সকল নারীর জন্য। এছাড়াও নারী উন্নয়ন নীতিমালা, ২০১১-এর ধারা ৩২ এ নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ উল্লেখ করা হয়েছে। এই নীতিমালার জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৩ এর ধারা ৩২.৭ এ আলাদাভাবে প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য সংসদে দুটি আসন সংরক্ষিত করা হয়েছে। সরকার প্রণীত এই কর্মপরিকল্পনাটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত করার কথা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত প্রতিবন্ধী নারীদের গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে প্রচারণাসহ কোনো রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

প্রাক-নির্বাচন, নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময় মিলে চলে নির্বাচনী চক্র। এই চক্রের প্রতিটি ধাপে প্রতিবন্ধী নারীদের অংশগ্রহণ বা অন্তর্ভুক্তি জোরদার করা প্রয়োজন। প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার অর্জনের কার্যক্রমে যেমন প্রতিবন্ধী নারীর বিষয়টি গুরুত্ব পায় না, তেমনি সাধারণ নারীদের জন্য নেওয়া পদক্ষেপেও প্রতিবন্ধী নারীর বিষয়টি আমলে নেওয়া হয় না।

এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোতে প্রতিবন্ধী নারীদের নির্বাচনী অধিকার বা রাজনৈতিক অংশগ্রহণের চিত্র প্রায় একই হলেও কিছু ব্যতিক্রম অবশ্য রয়েছে। যেমন ২০০৪ সালে আমাদের পাশের দেশ ভারতে নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করা হয়। ফলে সেখানে প্রতিবন্ধী মানুষের চাহিদা বিবেচনায় নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আসে। এ ছাড়া ভারতের মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়–সহ নেপালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনের সক্রিয় ভ‚মিকায় সেখানকার নির্বাচন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব করা হচ্ছে।

আমাদের দেশেও প্রতিবন্ধী নারীদের সক্রিয় হতে হবে। বিশেষ করে তাদের প্রতিবন্ধী নারী সংগঠন গঠনের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। তার লক্ষ্যে সরকারকে চাপ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সকল ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক ও ভোটাধিকার রক্ষায় বিশেষ চাহিদা বিবেচনায় রেখে নির্বাচনী আচরণ ও পরিচালনা বিধি সংশোধন করতে হবে। ভোটকেন্দ্রে প্রবেশগম্যতা ও ভোটদানে গোপনীয়তা বজায় রেখে স্বাধীন পদ্ধতিতে ভোটদানের ব্যবস্থা এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ধরনের ওপর সহায়তাকারীর প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডারে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ অনুসারে ব্যক্তির সব ধরনের প্রতিবন্ধিতার তথ্য সংরক্ষণ এবং গোপনীয়তার অধিকার রক্ষা করতে হবে। তা ছাড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রার্থী হিসেবে অন্তর্ভুক্তি, নির্বাচনী জনসচেতনতামূলক প্রচারণায় প্রতিবন্ধী নারীর উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়াসহ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সকল পর্যায়ের কমিটিতে প্রতিবন্ধী নারীর জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একীভূত প্রশিক্ষণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উপস্থিতি নিশ্চিতের লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত পোলিং কর্মকর্তাদের প্রতিবন্ধী পুরুষ ও নারী সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের ওপর প্রশিক্ষণ ও বিভ্রান্তি দূরীকরণে সহায়কসংবলিত তথ্যপত্র প্রকাশ করতে হবে। নির্বাচন কমিশনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক ফোকাল কর্মকর্তার কার্যাবলি ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করতে হবে, যাতে করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা প্রয়োজনীয় সহায়তা পেতে পারে। নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকার কর্তৃক নির্ধারিত কোটা বাস্তবায়ন ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভোটদানের বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে কেন্দ্রভিত্তিক প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষ আলাদা তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। প্রয়োজনে নির্বাচনের দিন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যেন যানবাহন ব্যবহার করতে পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিবন্ধী নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনসমূহকে পর্যবেক্ষণের কাজে সম্পৃক্ত করতে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সিআরপিডি সনদকে মূল সহায়ক হিসেবে গ্রহণ করে ভোটাধিকার বা রাজনীতিতে অংগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় আইন সংস্কারে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রাক্্-নির্বাচন যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াকে হালনাগাদ করতে হবে।

ম্যানেজমেন্ট বডিজ অব সাউথ এশিয়া (ফেমবোসা) এর ষষ্ঠ সভায় সম্মিলিতভাবে সকল দেশের নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধিবৃন্দ একটি ন্যূনতম সাধারণ মান তৈরিতে একমত হয়েছেন। কিন্তু আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশনার এ সভায় উপস্থিত থাকলেও এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। বিষয়টি বাস্তবায়নে অন্য ৮টি সদস্যদেশ কী ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে, তা নজরে রাখতে হবে। প্রতিবন্ধী মানুষকে কীভাবে আরও বেশি স¤পৃক্ত করা যায়, সেই বিষয়ে আমাদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের দেশ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছে। এসডিজি লক্ষ্য ১০.২ তে বয়স, লিঙ্গ, প্রতিবন্ধিতা ইত্যাদি অবস্থা নির্বিশেষে ২০৩০ সালের মধ্যে সকলের ক্ষমতায়ন নিশ্চিতে সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। তাই অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসহ সকল রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় প্রতিবন্ধী নারীর বিষয়গুলো আবশ্যিকভাবে এখনই অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। তার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোকে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেওয়াতে বিলম্বের কোনো সুযোগ নেই। তা না হলে কাউকে পিছনে ফেলে নয় এই নীতি বাস্তবায়ন দূরূহ হয়ে পড়বে।

নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ শীর্ষে; সরকার গৃহীত কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী নারী অনুপস্থিত

নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলোতে প্রতিবন্ধী নারীর অনুপস্থিতি নিন্দনীয়। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে সরকার সাধারণ নারীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও প্রতিবন্ধী নারীদের ইতিবাচক উন্নতি দেখা যাচ্ছে না।

গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ-২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ এবং বৈশ্বিক সূচকে ৫ম অবস্থানে রয়েছে। এদিকে হাউস অব লর্ডসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টাডি সার্কেল আয়োজিত এক বৈঠকে লেবার পার্টির জ্যেষ্ঠ সাংসদ জিম ফিটজপ্যাট্রিকস বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করে বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা এবং অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ইত্তেফাক, সমকাল, ঢাকা ট্রিবিউনসহ কিছু পত্রিকা এ নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়নের সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও প্রতিবন্ধী নারীদের স্বাধীন, মর্যাদাকর জীবনযাপনসহ ক্ষমতায়নের বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিগোচরে নেই।

বাংলাদেশে বর্তমানে নারীর ক্ষমতায়নে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, উদ্যোক্তা তৈরি, ঋণ প্রদান, প্রশিক্ষণ, নারী নির্যাতন বা যৌন সহিংসতা প্রতিরোধ এসব ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ দৃঢ়ভাবে লক্ষণীয়। তবে একই প্রাসঙ্গিকতায় প্রতিবন্ধী নারীদের বিষয়টি গৌণ। বরং প্রতিবন্ধী নারীরা সাধারণ মৌলিক অধিকার থেকেও হচ্ছে বঞ্চিত। এ ছাড়া সরকারি বা বেসরকারি নিয়োগ, প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যাভিত্তিক তথ্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জরিপ প্রতিবেদনে নিয়মিত পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে প্রতিবন্ধী নারীদের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। উপরন্তু তথ্যের খোঁজ চাইলে সরকারি দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা হিমশিম খেয়ে যান। স্থানীয় সরকারে সাধারণ নারীরা নির্বাচিত হলেও প্রতিবন্ধী নারীর অংশগ্রহণ-সংক্রান্ত তথ্য নির্বাচন কমিশন বা স্থানীয় সরকার কারও কাছেই নেই। অর্থা্ৎ সরকারের তথ্যভান্ডারে প্রতিবন্ধী নারীরা অদৃশ্য।

সরকারের এ সংখ্যাতাত্তি¡ক অবহেলা সমাজের প্রচলিত সেবা বা কল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। আবার গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বক্ষেত্রে প্রবেশগম্যতার অভাব। কারণ, সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবকাঠামোগত বাধা এ দুটি প্রতিবন্ধী নারীদের বৈষম্যপীড়িত অবস্থা আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে তাদের। অনুৎসাহিত করছে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে সম-অংশগ্রহণে। ফলে প্রতিবন্ধী নারী হয়ে পড়ছে জনবিচ্ছিন্ন। ব্যতিক্রমী মুষ্টিমেয় প্রতিবন্ধী নারীকে সাধারণ জনজীবনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে দেখা গেলেও ‘উন্নতি হচ্ছে’ নামক স্বপ্নটি আশ^স্ততার চার দেয়ালের ঘেরাটোপে ঘুরপাক খাচ্ছে।

এসডিজি লক্ষ্য ৫ এবং লক্ষ্য ৮-এর ৮.৫ সূচকে প্রতিবন্ধী নারীর জন্য সরাসরি নির্দেশনা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এসডিজি অর্জনে কাজ শুরু করার পর আমরা আশা করেছিলাম, সরকার প্রতিবন্ধী নারীদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তথ্য সংরক্ষণ, উপাত্ত বিনিময় এবং তা বিশ্লেষণ করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করবে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় ক্রমান্বয়ে সামাজিক নিরাপত্তা খাতই হয়ে উঠছে প্রতিবন্ধী নারীদের শেষ গন্তব্য। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকার বছর বছর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে এবং আওতা বাড়াচ্ছে। প্রশ্ন এসেই যায়, তাহলে কি এর মধ্য দিয়েই প্রতিবন্ধী মানুষের মুক্তির সমাধান খোঁজা হচ্ছে! এ কারণেই কি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এবং প্রবেশগম্যতাসহ অংশগ্রহণ, প্রতিনিধিত্ব, ক্ষমতায়নের মতো বিষয়সমূহে প্রতিবন্ধী নারীর বৈষম্যের প্রকটতা লক্ষণীয়!

বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী নারীদের ক্ষমতায়ন বা অগ্রগতির অবস্থা পরিমাপের জন্য প্রচলিত সূচকসমূহে নারীর পাশাপাশি প্রতিবন্ধী নারীর সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন প্রয়োজন। জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিবন্ধী নারীর জন্য নির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহের জন্য সরকারকে আরও বেশি সাহায্য সহযোগিতা ও প্রয়োজনে চাপ প্রয়োগে উদ্যোগী হতে পারে। নতুবা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ক্ষমতা ও সমতার ভিত্তিতে প্রতিবন্ধী নারীর বাধাহীন পূর্ণ অংশগ্রহণ ছাড়া চ‚ড়ান্ত বিশ্লেষণে ইতিবাচক পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে না।

ইন্টারসেকশনালিটি ও প্রতিবন্ধী মানুষের আন্দোলনে গণসংগঠনের ভূমিকা

সাবরিনা সুলতানা

 

ইতিহাসের ঊষালগ্ন থেকে গণমানুষের আন্দোলন ও দাবি অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে গণসংগঠনের নানা ধরনের কার্যক্রম। বর্তমান সমাজে নারীর বলিষ্ঠ অবস্থানের পেছনেও রয়েছে নারী গণসংগঠনগুলোর ভূমিকা।

আমাদের প্রতিবন্ধী মানুষের আজকের অবস্থান কি একদা অধিকারবঞ্চিত ও পুরুষ দ্বারা অবহেলিত নারীদের মতো নয়! নারীরা সংগঠিত হয়ে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে পেরেছিল বলেই তাদের মুক্তির আন্দোলন বৃথা যায়নি।

আজ  নারীরা ক্ষমতায়িত। অথচ দক্ষ নেতৃত্বের অভাব এবং সংগঠিত না হওয়ার কারণেই আমরা প্রতিবন্ধী মানুষেরা আজও  ক্ষমতাহীন। এত নিরাশার মাঝেও এক ফালি সূয্যি ঈশান কোণে উঁকি দিয়ে যায়। প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ (পিএনএসপি) এর কার্যক্রম ও চর্চাগুলো দেখে মনে প্রবল অভূনুতি কাজ করে, এই সংগঠন বুঝি প্রতিবন্ধী মানুষের মুক্তির সেই গণসংগঠন হবে। যেটি আমাদের প্রতিবন্ধী মানুষের বৈষম্য-নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে ছিনিয়ে আনবে আমাদের অধিকার। প্রতিবন্ধী মানুষকে সংগঠিত হতে উদ্বুদ্ধ করবে। মুক্তবুদ্ধির চর্চায় উৎসাহিত করবে প্রতিবন্ধী মানুষকে।

সত্যি বলতে কি, এমন মুক্তচিন্তা চর্চার জন্যই পিএনএসপি নিয়মিত পাঠচক্রের আয়োজন করে থাকে। এ বিষয়ে পিএনএসপি ফেসবুক পাতায় আমি দেখতে পাই সেখানে লেখা রয়েছে, রাষ্ট্র এবং সমাজে আমাদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমরা প্রতিবন্ধী মানুষেরা সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্নপ্রায়। বিরাজমান বৈষম্যপূর্ণ এই ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে হলে প্রতিবন্ধী জনগণকে সমাজের কাঠামো ও অন্তঃশক্তিসমূহ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। নিজেদের অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় স্ব-সচেতনতায়নের(Conscientization) বিকল্প নেই। এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে এবং নতুন চেতনায় প্রতিবন্ধী জনগণ, বিশেষত প্রতিবন্ধী তরুণদের উদ্দীপ্ত করে তুলতে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পিএনএসপি নিয়মিত পাঠচক্র আয়োজন করে।

আমি এ ধরনের আড্ডা আলোচনাগুলোতে থাকতে চেষ্টা করি। বুঝতে চেষ্টা করি প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনে সম-অধিকার বা সমাজে সম-অংশগ্রহণের জন্য আমি কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারি।

পিএনএসপি আয়োজিত নারী অধিকার আন্দোলনে নারী গণসংগঠনের ভূমিকাবিষয়ক এক পাঠচক্রে থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার। প্রধান আলোচক ছিলেন নিজেরা করি-এর সমন্বয়কারী খুশী কবির। এ ছাড়া মূলধারার গণসংগঠনে দীর্ঘদিন কাজ করা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী মহিমা বেগম তাঁর অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন এখানে। এই আলোচনায় থাকার সুবাদে সমাজের প্রচলিত প্রথাকে ভেঙে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার চেতনায় উদ্দীপ্ত নারীদের সংগঠিত হওয়ার লড়াই এবং দলবদ্ধ আন্দোলনের ইতিহাস জানা হলো আমার। একই সঙ্গে মূলধারার গণসংগঠনে মাঠপর্যায়ে কর্মসূচি সংগঠক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা শুনলাম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী মহিমা বেগমের কাছ থেকে।

নারী গণসংগঠন ও অধিকার আন্দোলনের এই ইতিহাস ও তাদের এগিয়ে যাওয়ার এই গল্প আমাদের অনুপ্রাণিত ও সমৃদ্ধ করবে বলেই আমার বিশ্বাস। তাই সেদিনকার বক্তব্য তুলে ধরার ক্ষুদ্র এই প্রয়াস।

যেকোনো আন্দোলনে গণমানুষের পক্ষে লড়াই করে তাদের অধিকারগুলো আদায় করার জন্য সৃষ্টি হয় গণসংগঠন। মূলত গণসংগঠন অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সাধারণ মানুষদের সম্পৃক্ত করে কাজ করে। প্রতিবন্ধী নারী অধিকার আন্দোলনের বিষয়ে খুশী কবির বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে সচেতনতায়ন করতে হবে। শুধু সচেতনতা বা ক্ষমতা নয়, এই দুয়ের মাধ্যমে নিজের বিশ্লেষণ করে উদ্যোগ এবং কার্যকরভাবে কাজ করার চলমান প্রক্রিয়াই হলো সচেতনতায়ন। তবে এই সচেতনতাবোধ ব্যক্তি যদি শুধুই ভেতরে লালন করে তাহলে কোনো মূল্য থাকল না। অধিকার অর্জনে এই বোধ কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে হবে। এখানেই গণসংগঠন ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া সামাজিক সংগঠনের সেবামূলক কার্যক্রম যেমন প্রয়োজন তেমনি ক্ষমতায়ন ও সচেতনায়তন ইত্যাদি নিশ্চিত করার জন্যই গণসংগঠন সৃষ্টি করারও প্রয়োজন রয়েছে।

সত্তর-আশির দশক থেকে প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব, অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম শুরু হয়। সে সময় এই উদ্দেশ্য পূরণে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও উন্নয়ন সংগঠনের উদ্যোগে গণসংগঠন তৈরির প্রয়াস পায়। তবে সরকারি নিবন্ধন জটিলতা ও অর্থায়নের অভাবে এই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বর্তমান সময়ে টেকসই অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়ে বলা হচ্ছে। তবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় গিয়ে দেখা যায়, তাদের সম্পৃক্ততা নেই। তারা যদি সম্পৃক্ত না হয়, তবে সুস্পষ্টভাবে তাদের অধিকারের বিষয়গুলো উঠে আসবে না। যেভাবে নারী আন্দোলনের শুরু থেকে নারীর কথা নারীরা নিজেই বলেছে। যেমন আমরা নিজেরা করি ভূমিহীন, ক্ষেতমজুর ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিজস্ব গণসংগঠন গড়ে তুলতে তাদের সাথে থেকে কাজ করি। আমরা ক্ষুদ্রঋণ দেই না। আমরা কোনো সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করি না। তাদের নিজের অধিকার আদায় করার জন্য তাদেরকে সংগঠিত করি। যেন জনগণ নিজের অধিকার নিজেই আদায় করতে পারে, তা নিশ্চিত করাই আমাদের কাজ। আমরা তাদের সঙ্গে কাজ করি, তাদের পক্ষে না। পক্ষে কাজ করা বলতে বোঝায় সরকারি দপ্তরে চিঠি দিয়ে আসা। তাদের অধিকারগুলো যেন সরকার বাস্তবায়ন করে, সে বিষয়ে কাজ করা। সাথে থাকা মানে হচ্ছে তাদের কাজ তারাই করবে, আমরা শুধু পাশে থাকব। যাতে তারা একাবোধ না করে এবং শক্তি পায়। বিদেশি এক গবেষকের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, গণসংগঠন নিয়ে কর্মরত সংগঠনগুলোর মধ্যে নিজেরা করি ছাড়া বাকি সবাই হয় বন্ধ হয়ে গেছে নতুবা কার্যক্রমহীন হয়ে পড়েছে। কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, নিজেরা করিতে কর্মরত অধিকাংশ কর্মীই পনেরো/বিশ বছর ধরে কাজ করে চলেছেন। তারা এই কাজটিকে নিজস্ব কাজ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এ কারণেই সংগঠনটিও টিকে গিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সংগঠন পরিচালনা করতে অর্থের প্রয়োজন খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গণসংগঠনগুলো দাতা সংস্থার পছন্দ-অপছন্দ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত হয় না। যে শর্ত তার মূল ভাবনা থেকে দূরে ঠেলে দেয় সংগঠনকে, তেমন কাজ গণসংগঠন করে না। সমাজ এবং জনগণের জন্য যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেই বিষয়ে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যায় গণসংগঠন। তবে এই আন্দোলন এগিয়ে নিতে সরকারকেও আশ্বস্ত করা যে আমরা কোনো সংবিধান কিংবা আইনবিরোধী কার্যক্রম করছি না। আইন, নীতি, স্বচ্ছতা এবং অধিকার প্রয়োগের জন্য আমরা কাজ করছি।

সংগঠনে অর্থ পর্যাপ্তের চেয়েও বেশি হলে অপব্যয়ের মন্দাভাব জন্মায়। অর্থাৎ অর্থ খরচই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উল্লেখ করে তিনি তাদের এনজিওমুখী আচরণের সমালোচনা করে বলেন, পূর্বে জেলা-উপজেলায় গণসংগঠন হিসেবে মহিলা পরিষদ প্রত্যেক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করত। কিন্তু বর্তমানে তাদের কার্যক্রম এনজিও ঘরানার হয়ে গেছে। আমরা জানি বাংলাদেশে অনেক আইন থাকলেও বাস্তবে যার কোনো প্রয়োগ হয় না। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাগুলোরও সঠিক প্রয়োগ নেই। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, গণসংগঠন থাকলে আমরা এ বিষয়গুলোতে চাপ দিতে পারতাম।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) এর প্রসঙ্গ ধরে তিনি সতর্ক করে বলেন, এসডিজির কারণে এখন অনেকেই প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে এনজিওমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করতে চাইবেন। এ বিষয়ে তিনি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনগুলোকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান যেন আমরা নারী আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে শর্তের ঘেরাটোপে পড়ে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ি।

নারী আন্দোলন বা নারীবাদ নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের ইন্টারসেকশনালিটি নামক নতুন ধারণার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, পৃথিবীর বহু দেশেই বর্ণবাদ এখনো শক্তিশালীভাবে বিরাজমান। এ ছাড়া ধর্ম নিয়ে আক্রমণ, ভেদাভেদ এবং আমাদের সমাজে শ্রেণিবিভক্তি এসবই একেকটা সেকশন। যেমন মানুষের মধ্যে নারীরা অধিকারবঞ্চিত হয়। শ্বেতাঙ্গ নারীর চেয়ে কালো নারী আরও বেশি বঞ্চিত হচ্ছে। আবার বাংলাদেশের শিক্ষিত নারী কিন্তু ইংরেজি ভালো বলতে না পারার কারণে আফ্রিকা থেকে আগত নারীর সাথে বৈষম্যের মাপকাঠিতে পিছিয়ে যাচ্ছে। তার মানে শ্রেণিগত অবস্থানটা আমার চামড়া রঙের অবস্থার সাথে পার্থক্য করছে। আবার ধর্মের ভিত্তিতেও বৈষম্য হয় যেমন সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে মুসলিম নারীর চেয়ে হিন্দু নারী নানাভাবে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে দেখা যায় অপ্রতিবন্ধী নারীর চেয়ে প্রতিবন্ধী নারীরা বেশি বঞ্চিত হয়। আবার প্রতিবন্ধী নারীর মধ্যেও বৈষম্যপীড়িত যেমন শ্রবণ প্রতিবন্ধী নারীরা অন্য প্রতিবন্ধী নারীদের তুলনায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে বেশি বঞ্চিত হয়। তাদের চেয়েও আরও বেশি বঞ্চিত মনোসামাজিক এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নারীরা।

সকল নারী সাধারণভাবে কয়েকটা জায়গায় বৈষ্যমের শিকার হচ্ছে। সামাজিক ভ্রান্ত ধারণা থেকে আমাদের পারিবারিক জীবনেও বৈষম্য আসে। যেমন মেয়ে মানে রাতে ঘরের বাইরে যাবে না। মেয়ে মানে সে বাইরে কাজ করতে পারবে না। মেয়েরা ভারী কাজ করতে পারবে না। ছেলেরা যা পারবে মেয়েরা তা পারবে না। মেয়ে মানে তাকে বিয়ে করতেই হবে। এমন নেতিবাচক ধারণার কারণেই ২০১৭ সালের আলোচিত বনানী ধর্ষণ ঘটনার পর মেয়েরা রাতে কেন বনানীতে গিয়েছিল এই বিষয়টি সামনে চলে আসে। প্রশ্ন এসেই যায় ছেলেরা যেতে পারলে মেয়েরা যাবে না কেন! রাতে কোথাও যাওয়ার মানে, এই নয় যে ধর্ষণ করার অধিকার নারী পুরুষকে দিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ ধর্ষকের বা ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য একটি অপরাধের বিরুদ্ধে আলোচনা-সমালোচনা না করে আমরা নারীর ভুল খুঁজতে বেরিয়েছি। অন্যদিকে দেখা যায় আমাদের জনগোষ্ঠীর গড়ে ৫০ ভাগ নারী যাদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গোটা নারী সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য তাদের পরিশ্রমও করতে হয়েছে প্রচুর। এই পর্যায়ে আসার পরবর্তী সময়ে নারীর চরিত্র নিয়ে কথা শুরু হয় আমাদের সমাজে। আবার এও লক্ষণীয়, মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী নারী হওয়ায় আমরা খুব গর্ববোধ করছি। কিন্তু আমাদের দেশের ইটভাঙার নারী শ্রমিকেরা, তাদের বৈষম্য, অত্যাচার, নির্যাতন এবং শোষণের মাত্রা অকল্পনীয়।

তাই মেধাজীবী নারীর সাথে শ্রমজীবী নারীর বৈষম্যের বিস্তর পার্থক্যও একধরনের ইন্টারসেকশনালিটি। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নারীর অবস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্যের তারতম্য রয়েছে। এই যে নারীর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান এবং তার এই অবস্থানের তারতম্যের ভিত্তিতে অধিকার ও বৈষম্যের যে পার্থক্য হয়, তারই অন্তঃসম্পর্ক হচ্ছে ইন্টারসেকশনালিটি। ইটভাটার পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে নারী শ্রমিকের বৈষম্যও ইন্টারসেকশনালিটির আরেকটি উদাহরণ। ইন্টারসেকশনালিটি আমাদের শেখায় যেকোনো বিষয়, শ্রেণি এবং গোষ্ঠীর মধ্যকার সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে।

প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়টিই ধরুন- যারা হুইলচেয়ার ব্যবহার করেন তারা ভালো করেই জানেন, সর্বত্র হুইলচেয়ার প্রবেশগম্যতা না থাকা কতটা বেদনাদায়ক। যিনি ক্রাচ ব্যবহার করেন, ছয়তলায় উঠবার যাতনা তিনিই ভালো বুঝবেন। কিন্তু কেন? কেন আমাদের প্রত্যেকটি জায়গায় এভাবে সইতে হবে। এ পর্যায়ে তিনি বাংলা ইশারা ভাষার উদাহরণ দিয়ে বলেন, আমার অক্ষমতা আমি বাংলা ইশারা ভাষা জানি না। আমি যদি শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের সাথে মিশতে চাই আমাকে বাংলা ইশারা ভাষা জানতে হবে। নতুবা আমাকে নির্ভর করতে হচ্ছে দোভাষীর ওপর। তার মানে দেখা যাচ্ছে, আমরা সব জায়গায় দোভাষীর ব্যবস্থা না রাখার ফলে এখানেও ব্যাপক বৈষম্য ঘটে যাচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে একটি স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমার পরিচিত হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী একজন ভাইয়ের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিচতলায় পাঠ গ্রহণ এবং আবাসিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ফলে তার পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটছে না। কিন্তু তারই হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী বোনের জন্য উপযোগী বিদ্যালয় কিংবা আবাসিক ব্যবস্থা খোঁজা হচ্ছে না। এখানে দেখা যাচ্ছে একই ধরনের মানুষের মধ্যে একজন একই সুবিধা পাচ্ছে অন্যজন পাচ্ছে না। এটা হচ্ছে প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে ঘটে যাওয়া ইন্টারসেকশনালিটি। প্রত্যেকটা বিষয়ের মধ্যে এমন পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যগুলো আমাদের পরিবর্তন করতে হবে। এই বিষয়গুলো তুলে ধরবেন আপনারা আর বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসাই হবে আমাদের আন্দোলন। প্রত্যেকটা আন্দোলনেই আপনার, আমার তথা আমাদের সকলের অংশগ্রহণ জরুরি।

আমি মনে করি, নারী অধিকার আন্দোলনে গণসংগঠনের ভূমিকা অনেক জরুরি। তা না হলে নারী অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত হবে না। ঠিক একইভাবে আপনাদের প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে আপনাদের নিজেদের ভূমিকা রাখাটাই অনেক বেশি অপরিহার্য। আপনাদের গণ-আন্দোলনে গণসংগঠন অবশ্যই করা দরকার। গণসংগঠন ছাড়া অধিকার কখনো অর্জন করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে আপনাদেরই গণসংগঠন তৈরি করতে হবে। গণসংগঠন হিসেবে আপনি যে প্রতিষ্ঠানেই থাকেন না কেন, যে জায়গাতেই থাকেন না কেন- আপনারা আপনাদের কণ্ঠ, বক্তব্য, আপনাদের চিন্তাগুলো তুলে ধরবেন এবং আমাদের জানাবেন, আমরা যেন আপনাদের পাশে থাকতে পারি। আবার এখানে এটিও লক্ষ রাখা জরুরি, গণসংগঠনগুলো কী চাইছে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সমাজ এবং জনগণের প্রয়োজনীয় বিষয়টি নিয়ে গণসংগঠনকে কাজ করতে হবে।


রাফিদ রহিম, কার্টুন ফ্যাক্টরি

স্মরণে রফিক জামান: প্রতিবন্ধী মানুষের মুক্তির আন্দোলন ও আমরা

নিশাত আফরোজ কান্তা

শূন্যতা মানেই শেষ নয়। চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের গন্তব্য শেষ হলেও মানুষের রেখে যাওয়া কর্ম, আদর্শ ও চেতনা তাকে অমর করে রাখে। রফিক জামান রিমু এমনই একজন, যিনি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতা চর্চার বিরোধিতা করে সামষ্টিক এবং সামগ্রিক নেতৃত্ব চর্চার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে তাদের এক সুতোয় গাঁথার চেষ্টা করেছিলেন।

প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে সমন্বয় এবং তাদের স্বাধীন ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাত্রা চর্চা অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্য বাঁচিয়ে রাখতে তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে গত ১২ মার্চ প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ (পিএনএসপি) কার্যালয়ে ‘স্মরণে রফিক জামান: প্রতিবন্ধী মানুষের মুক্তির আন্দোলন ও আমরা’ শীর্ষক এক স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। সভায় উপস্থিত আলোচকগণ মনে করেন, রফিক জামানের শূন্যস্থান পূরণের মতো গ্রহণযোগ্যতা এ মুহূর্তে কারও নেই, তবু মুক্তবুদ্ধির চর্চা চালিয়ে যেতে হবে। তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ ও পথনির্দেশনাকে কর্মে পরিণত করতে প্রতিবন্ধী তরুণ নেতৃত্বকে হাল ধরতে হবে।

সভায় বক্তব্য প্রদানকালে শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠন সোসাইটি অব দ্যা ডেফ অ্যান্ড সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজারর্স (এসডিএসএল) ও পিএনএসপির সভাপতি এম ওসমান খালেদ বলেন, বাংলা ইশারা ভাষার স্বীকৃতি এবং প্রসারে রফিক জামানের ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসংগঠন (ডিপিও) সমূহের মধ্যে সমন্বয় তৈরি ও তাদের প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব চর্চার প্রতি তাগিদ দিয়ে রফিক জামান কাজ করতেন। প্রতিবন্ধী মানুষের খাতে তার দশ বছরের কর্মজীবন কেটেছে এই প্রচেষ্টাতেই।

পিএনএসপির সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব বলেন, রফিক ভাই প্রতিবন্ধিতাকে মানববৈচিত্র্য হিসেবে স্বীকার করে আমাদের এ নিয়ে গর্ব করতে বলতেন। অসুস্থতা, অস্বাভাবিকতা ইত্যাদি নেতিবাচক ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মমর্যাদাসহ জীবনধারণে উদ্বুদ্ধ করতেন। সেই চেতনা নিয়ে রাজনৈতিক এবং বিভিন্ন কর্মকান্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মুক্তির পথকে আমাদের নিজেদের খুঁজে নিতে বলতেন তিনি। প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়নের প্রশ্নে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে পিএনএসপির পক্ষ থেকে আমাদের সাধ্যমতো কাজ করে যাব।

জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের সাবেক কর্মকর্তা এবং বর্তমানে বেসরকারি সেবা প্রদানকারী সংস্থায় কর্মরত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, রফিক জামানের শূন্যতা পূরণ সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের মধ্যে সঠিক সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে এই সমন্বয় সাধনে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গ্রহণযোগ্যতা এ মুহূর্তে আমাদের নেই। তিনি আরও বলেন, ব্যক্তি রফিক জামানের ক্ষমতাকেন্দ্রিক আকাঙ্খা ছিল না। তিনি ছিলেন প্রতিবন্ধী মানুষমুখী। সার্বিকভাবে তিনি প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়নের প্রতি জোর দিয়ে কাজ করতেন। মোশাররফ মনে করেন, আমাদের মধ্যে যৌথ নেতৃত্ব চর্চার প্রয়োজন রয়েছে এবং এভাবেই একসময় যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি হবে।

জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের সাবেক সমন্বয়কারী এবং বর্তমানে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশে কর্মরত জাহিদ কবির টিটু বলেন, রফিক জামানের আশপাশের মানুষ যখন অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম ও সমৃদ্ধিশালী হচ্ছেন, তখন তিনি প্রান্তিক মানুষের সামগ্রিক পরিবর্তনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন তৈরির লক্ষ্যে কাজ করেছেন। জাহিদ কবির মনে করেন, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনের সমাপ্তি ঘটে এবং জীবনের গন্তব্য শেষ হয়। এ কারণেই রফিক জামানের অসমাপ্ত কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষের খাতে কাজ করতে এসে রফিক জামান তার রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সর্বস্তরে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল সক্রিয় অংশগ্রহণের দিকে জোর দিয়েছেন। তবে প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতার অভাবে অপ্রতিবন্ধী মানুষেরা সুযোগ নিচ্ছে। ফলে প্রতিনিধিত্বের চর্চা করা তাদের জন্য কঠিন।

রফিক জামানের দীর্ঘ নয় বছরের সহকর্মী ইফতেখার মাহমুদ বলেন, আমাদের মধ্যে ঐক্যমতের অভাবের প্রকটতা ব্যাপক। এ কারণেই এ দেশে এখন পর্যন্ত কোনো সাংস্কৃতিক বা আদর্শতাত্তি¡ক বিপ্লবের সূচনা হয়নি। যা হয়েছে তা এনজিওনাইজেশন প্রক্রিয়ার ফল। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মুক্তচিন্তা চর্চার সীমাবদ্ধতার কারণে প্রকৃত অর্থে আমাদের মুক্তির পথ নিজেদের কাছেই অজানা। শুধু উন্নয়ন কর্মকান্ডের নামে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে নিমজ্জিত এবং অংশগ্রহণের মধ্যে জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন জগৎ থেকে বেরিয়ে আসার তাড়নায় নিয়োজিত রাখা হয় আমাদের। ফলে মুক্তির সংগ্রাম ব্যক্তি হিসেবে অনেকেই করছে কিন্তু সামষ্টিক লড়াই প্রয়োজন।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রিফাত তালুকদার মনে করেন, প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্ব চর্চা সম্ভব তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। একই সূত্রে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রাজীব বলেন, রফিক ভাই পিএনএসপিতে নিয়মিত আড্ডা-আলোচনার মাধ্যমে মুক্তচিন্তার চর্চা করতেন। এতে প্রতিবন্ধী তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেন। রফিক ভাই আমাদের উদ্দীপ্ত করতে পারতেন। পিএনএসপির এই চর্চা অব্যাহত রাখতে প্রতিবন্ধী মানুষের একত্র হওয়ার ক্ষেত্রে তাগিদ দেন সগির হোসাইন, আসমা আহমেদসহ সভায় উপস্থিত অনেকেই।

রফিক ভাই অনেক গতিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন উল্লেখ করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষক মাহমুদা বলেন, প্রতিবন্ধিতার ধরনগত বৈচিত্র্য অবস্থান এবং চিরায়ত বিচ্ছিন্নতার মধ্যে নিহিত রয়েছে প্রতিবন্ধী মানুষেরা। তাই হয়তো অনেকেই তার এই গতিকে ভয় পেতেন। পরিচয়ের প্রথম দিকে আমিও ভয় পেয়েছি। কিন্তু তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ধীরে ধীরে এই ভীতি ভেঙে যায় এবং অনুপ্রেরণা পাই স্বাধীন চলাচলের।

একা চলার মধ্যেও আত্মবিশ্বাস অর্জন এবং তার কারণে জীবন পরিবর্তন হতে পারে, তা রফিক জামানের কাছে শেখেন নুরুন্নাহার তনিমা। তিনি বলেন, ঘরের বাইরে বাবা-মায়ের সঙ্গেই চলাফেরা করতে হয়েছে। কারণ, তারা ভয় পেতেন, কিন্তু রফিক জামানই প্রথমে আমার ও মা-বাবার এই ভীতি ভেঙে দেন। একা বাইরে চলাচলের সাহস জোগান। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী তনিমা বলেন, এরপর থেকে ঘরের বাইরে একা একাই চলছি। রফিক জামান আমাদের প্রতিবন্ধী মানুষের মন থেকে ভয়ভীতি বা অন্ধকার দূর করতে পারতেন।

সরকারি পরিসংখ্যানে অদৃশ্য প্রতিবন্ধী মানুষ; উপেক্ষিত এসডিজিতেও

ইফতেখার মাহমুদ/আহসান হাবিব

সরকারি পরিসংখ্যানে অদৃশ্য প্রতিবন্ধী মানুষেরা। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)তেও তারা উপেক্ষিত। অন্যদিকে চাপা পড়ে যাচ্ছে জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদ (সিআরপিডি) এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক আইন ও নীতিমালাগুলো। ফলে ক্ষমতাকাঠামোর বাইরে রয়ে যাচ্ছে প্রতিবন্ধী মানুষ।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগ (জিইডি) সম্প্রতি এসডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদন-২০১৮ প্রকাশ করে। এসডিজির সতেরোটি লক্ষ্যমাত্রার সাতটিতে সরাসরি প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী মানুষদের অগ্রগতির বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যানগত উপেক্ষার ফলে এসডিজি বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা ও গৃহীত উন্নয়ন কর্মসূচি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। একই সঙ্গে, তা প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়নকেও বাধাগ্রস্ত করে তুলেছে।

বিশ্লেষকদের মতে এসডিজি বাস্তবায়নের অন্যতম উদ্দেশ্য তথ্য-উপাত্তের বিপ্লব (ডেটা রেভল্যুশন) ঘটানো। কিন্তু উল্লেখিত প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসংশ্লিষ্ট সূচকসমূহে কোনো তথ্য উপস্থাপন না হওয়ায় সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি খর্ব হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। কারণ হিসেবে বিশ্লেষকেরা জাতীয় পর্যায়ের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক কমিটিগুলো সক্রিয় না থাকা এবং সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন। প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় আন্দোলনের অভাবকেও দায়ী করছেন প্রতিবন্ধী মানুষের নেতৃবৃন্দ। এ ছাড়া দীর্ঘদিনের প্রচলিত কল্যাণভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে উন্নয়ন কর্মকান্ডগুলো আবদ্ধ থাকছে দয়া-দাক্ষিণ্যের ঘেরাটোপে।

বাংলাদেশ এসডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদন ২০১৮ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তথ্যপ্রাপ্তির দিক থেকে ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম। এতে আরও দেখা যায়, এসডিজির ২৩২টি সূচকের মধ্যে বাংলাদেশের মাত্র ৭০টি সূচকের তথ্য রয়েছে। যেখানে ডেটা গ্যাপ অ্যানালাইসিস প্রতিবেদন ২০১৫ অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়ে তথ্য ঘাটতিতে ব্যাপক প্রকটতা দেখা গিয়েছিল, সেখানে দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এই অগ্রগতি প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি।

সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ একে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে সঠিক তথ্য সরবরাহের অভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য নেওয়া উন্নয়ন কর্মসূচিসমূহ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় সমাজকল্যাণের দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য এই প্রতিবেদনে নেই উল্লেখ করে প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ (পিএনএসপি) এর সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব বলেন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যবিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রবেশগম্যতা প্রভৃতি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগসমূহের ওয়েবসাইট, বার্ষিক প্রতিবেদন, বিশেষ প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী মানুষের কোনো ধরনের তথ্যের সন্ধান মেলে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হাউসহোল্ড ইনকাম সার্ভে এবং ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ্ সার্ভে এই প্রতিবেদন দুটিতে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যার বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও কৃষিশুমারি, কর্মসংস্থান জরিপ, নারীর ক্ষমতায়ন, সম্পদের মালিকানা অথবা অর্থনৈতিক অগ্রগতিবিষয়ক জরিপসমূহের কোনো সূচকে তাদের তথ্য পরিলক্ষিত হয় না। এমনকি দারিদ্র্যবিমোচন জরিপের কোনো অংশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু আমরা জানি, দেশের চরম দারিদ্র্যপীড়িতদের একটি বড় অংশ প্রতিবন্ধী মানুষ।

এই প্রতিবেদন প্রকাশ করতে গিয়ে সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগ (জিইডি) এর সদস্য জনাব শামসুল আলম বলেন, তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো শক্তিশালী ভ‚মিকা রাখতে পারে। এ প্রসঙ্গে জিইডি এর সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রকল্প পরিচালক ও যুগ্ম প্রধান ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জিইডি তথ্য-উপাত্ত ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান, সংগ্রহকারী নয়। তথ্য সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভ‚মিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ম্যাপিংয়ের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত (লিড) মন্ত্রণালয় এবং সহযোগী মন্ত্রণালয়ের ওপরও দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে।

তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহের ক্ষেত্রে এই মন্ত্রণালয়সমূহ কেন ভ‚মিকা রাখছে না, প্রতিবেদকের এই প্রশ্নের জবাবে তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়গুলোতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনসমূহকে জনওকালতি করার পরামর্শ দেন।

অপর দিকে বিবিএসের ডেমোগ্রাফি ও হেলথ বিভাগের উপপরিচালক ইফতেখাইরুল করিমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণের প্রক্রিয়া মাত্র শুরু করেছেন তারা।

প্রতিবন্ধী মানুষের তথ্য ঘাটতির সবচেয়ে বড় কারণ সরকারি কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়হীনতা বলে মনে করেন ভিজুয়্যালি ইমপেয়ার্ড পিপলস্ সোসাইটি (ভিপস) এর সাধারণ সম্পাদক নাজমা আরা বেগম পপি। তিনি বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভ‚মিকা এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে সক্রিয় আন্দোলনের অভাব উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, অবিলম্বে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর বাস্তবায়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

সিআরপিডির পরিবীক্ষণ কমিটির সদস্য এবং টার্নিং পয়েন্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক জীবন উইলিয়াম গোমেজ মনে করেন, তথ্য ঘাটতির অন্যতম কারণ প্রতিবন্ধী মানুষের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্বের অভাব। তা ছাড়া এসডিজির কারণে সিআরপিডির বাস্তবায়ন গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। আর প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনকে দয়া বা কল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার কারণে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বাইরে আমরা কিছু ভাবতে পারছি না।

এ প্রসঙ্গে এসডিজি অ্যালায়েন্স অন ডিসঅ্যাবিলিটির পরামর্শক নাফিসুর রহমান বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবিষয়ক আইনের জাতীয় সমন্বয় ও নির্বাহী কমিটি এবং সিআরপিডি পরিবীক্ষণ কমিটির সক্রিয় ভ‚মিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া আসন্ন ২০২১ সালের আদমশুমারিতে প্রতিবন্ধী মানুষের সঠিক তথ্য সংগ্রহের জন্য ২০১১ সালের তথ্য সংগ্রহের ফরমের প্রশ্নসমূহে ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণের তাগিদ দিয়ে তিনি এ বিষয়ে বিবিএসের সঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনগুলোকে আলোচনা করার পরামর্শ দেন।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে; প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিদফতর গঠনের যৌক্তিকতা


সাবরিনা সুলতানা

বাংলাদেশ সরকার যখন এসডিজি অর্জনে দেশব্যাপী এবং বছরব্যাপী কার্যকর কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে, সেই কার্যক্রমগুলির প্রতিটি ধাপে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং তাদের নেতৃত্বের পুর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণের আহ্বান ছিল জাতিসংঘ ঘোষিত এবছরের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি দিবসের প্রতিপাদ্যে। বাংলাদেশ সরকার গৃহীত প্রতিপাদ্যটি বলতে বা শুনতে সহজ এবং সুন্দর হলেও মূলত সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রতিবন্ধী মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার আহ্বানটিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী! আমাদের আক্ষেপ বছরের পর বছর ধরে অমর্যাদাকরভাবে দিবসের নামকরণ হচ্ছে, আমরা চুপ থেকেছি। সমাজকল্যাণের কল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে অতীষ্ঠ, বিরক্ত আমরা চুপ থাকি। সাধারণ নাগরিকের সম অধিকার যদি মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বরাদ্দ হয়, আমরা প্রতিবন্ধী নাগরিকেরা তা থেকে বঞ্চিত হয়েও চুপ থাকি। কিন্তু প্রতিবন্ধী জনগণ এবং তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনসমূহের প্রাণের দাবি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতরের বাস্তবায়ন প্রসঙ্গকে এক বক্তব্যে উড়িয়ে দেওয়া কোনভাবেই মেনে নিতে পারা যায় না।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “ফাউন্ডেশনকে একটি পরিদপ্তরে রূপান্তরিত করা সঠিক নয়। ফাউন্ডেশন থাকলে আর্থিক অনুদান আসবে এবং ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে”।

জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন প্রাঙ্গনে নবনির্মিত জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন কমপ্লেক্সে ’সুবর্ণ ভবন’ উদ্বোধনকালে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে পরিদপ্তরে উন্নীত করার দাবি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “এতে সরকারি কর্মকর্তারা অনেক লাভবান হবেন, কিন্তু আমি বলতে পারছি না প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এ থেকে কতটুকু লাভবান হবে। তাই ফাউন্ডেশন হিসেবেই এটি থাকবে এবং আমরা ইতিমধ্যে সমাজকল্যাণ পরিদফতর প্রতিষ্ঠা করেছি”।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এহেন বক্তব্যে আমরা ক্ষুদ্ধ এবং বিস্মিত। আমরা প্রতিবন্ধী মানুষেরা, যারা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দিন রাত কাজ করছি, তারা জানি তদারকি ও আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিবন্ধী মানুষের একটি স্বতন্ত্র অধিদফতরের প্রয়োজনীয়তা কতটা অপরিহার্য!


সিআরপিডি’র অঙ্গীকার রক্ষায় অধিদফতর বাস্তবায়নের ইতিকথা
বিশ্বে প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়ন দর্শন ও বাস্তবায়নে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদ (সিআরপিডি)। বাংলাদেশ সরকার ২০০৭ সালে এই সনদে অনুসমর্থন করে। এরপর সরকার সিআরপিডির আলোকে আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে প্রশাসনিক কাঠামো সৃষ্টির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সেই অনুসারে এই সনদের জাতীয় বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণের (ধারা-৩৩) আলোকে ৪৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিষয়ক ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা নিয়োগ করে সরকার। তবে এ কর্মকর্তাদের জন্য সুনিদিষ্ট কোন নির্দেশনা না থাকায় নিজ নিজ দায়িত্বাবলী সর্ম্পকে তারা অবগত নন। সিআরপিডি পরীবিক্ষণ কমিটি গঠিত হয়, যে কমিটির বছরে চারটি বৈঠক হওয়ার কথা। শেষ কবে এ কমিটি বসেছে তা খুঁজতে খড়ের গাঁদায় সূঁচ খোঁজার মতো অবস্থা হবে। এছাড়াও এ সনদের আলোকেই পর্যায়ক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন, ২০১৩ পাস হয়েছে।

সিআরপিডি এর অঙ্গীকার বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর প্রথম অনুমোদন পায় ২০১০ সালে। বিশ্ব অটিজম দিবস উদযাপনকালে ঐ বছর ২ এপ্রিলে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে বিলুপ্ত করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতরে রূপান্তরের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। একই বছরের আগস্ট মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অধিদফতরের সাংগঠনিক কাঠামোর অনুমোদন দেয়। নানা জটিলতা কাটিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ও এর অনুমোদন দেয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নসহ নানা জটিলতায় থমকে যায় এই প্রক্রিয়া।

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস ৪ এপ্রিল, ২০১৪ উদযাপনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও বিগত ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতরের ফলক উন্মোচন করেন। এরপর ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্য অর্থমন্ত্রী অধিদফতর গঠনের বিষয়টি উল্লেখ করলে অর্থ মন্ত্রণালয়ও এই বিষয়ে অনুমোদন দেয়। এরপর জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন প্রাঙ্গনে অধিদফতরের জন্য আলাদা একটি নয় তলা ভবন নির্মাণ কাজ শুরুর মাধ্যমে বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করে অধিদফতর গঠন প্রক্রিয়া। তা বাস্তবায়নের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি প্রশাসনিক কমিটিও গঠন করা হয়েছিলো।

যদিও এই উদ্যোগের শুরু থেকে কয়েকজন আমলা এবং ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা-বোর্ডের বেসরকারি সদস্য ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সেবাদানকারী গুটিকয় এনজিও নেতৃবৃন্দ স্বীয় স্বার্থে এর বিরোধিতা করে আসছিলো। ফলে বারেবারেই মুখ থুবড়ে পড়ছিলো প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনকৃত অধিদফতর গঠন প্রক্রিয়া।


অধিদফতরের স্বপক্ষে
বাংলাদেশে স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ের সর্বস্তরে প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়ন এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর গঠনের কোন বিকল্প নেই। এই নির্দেশনা রয়েছে জাতিসংঘ সনদ সিআরপিডিতেও। সিআরপিডি অনুসমর্থনকারী বিভিন্ন দেশ যেমন ভারত সরকারও ২০১২ সালের মে মাসে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ক্ষমতায়ন অধিদফতর চালু করেছে।

এ অধিদফতরের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে নানা আয়োজনে সরকারি উর্ধ্বতন ব্যক্তিরাও মত দিয়েছে। প্রতিবন্ধী মানুষের অধিদফতর বাস্তবায়নে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিরোধিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে জাতীয় সংসদের ডেপুটি ¯ উপকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরেও কী কারণে অধিদফতর হচ্ছে না তা আমার বোধগম্য নয়। আমরা কি পাকিস্তানি আমলের আমলাতান্ত্রিক সেই ভূতের মধ্যে রয়ে গেছি? আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি দিবস ২০১৬ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তব্যর একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীকে অধিদফতর বাস্তবায়নের আহবান জানিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি আরও বলেছিলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে এবং প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়নে তাদের প্রতিনিধিত্ব গুরুত্বপূর্ণ। 

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কর্তৃক ২০১৭ সালের ১৫ জুন আয়োজিত (খসড়া) প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. জিল্লার রহমান বলেছিলেন, সমাজসেবা অধিদফতর অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে আইনের কমিটি নিয়ে কাজ করার ফলে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সব কমিটি কার্যকরভাবে গঠন এবং এর কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। এ সময় তিনি আরও বলেছিলেন, প্রক্রিয়াধীন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর বাস্তবায়িত হলে এ সংকট কেটে যাবে।

এছাড়াও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনের প্রতিনিধিত্বকারী ডিপিও নেটওয়ার্ক প্রতিবন্ধী নাগরিক সংগঠনের পরিষদ স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ের সর্বস্তরের কমিটিতে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্বের দাবীতে দেশব্যাপি সোচ্চার হয় ২০১৪ সাল থেকে। একই ধারাবাহিকতায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিদফতরের বাস্তবায়নের দাবী নিয়ে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশজুড়ে কঠোর আন্দোলন চালিয়ে যায়।
জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন এর কর্মকান্ডে সিআরপিডি কোথায়?!

অতীতে নারী সনদ সিডও বাস্তবায়ন এবং নারীর ক্ষমতায়নে জেলা-উপজেলায় কার্যক্রম বাস্তবায়নে গঠিত হয় মহিলাবিষয়ক অধিদফতর। সব মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট বাস্তবায়নে এ অধিদফতর সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করছে। নারী অধিদফতর গঠনের কারণে যেমন সরকারের সকল মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট বন্ধ হয়নি বরঞ্চ নারীদের সমাজের মূলধারার উন্নয়নের প্রক্রিয়া বাস্তবায়নেই এই বাজেট আরও গতি পেয়েছে এবং সেই সকল কার্যক্রম সমন্বয় ও পরিচালনাতে জোরালো ভূমিকা পালন করছে নারী অধিদফতর। দেশের নারী সংগঠনগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ অনুদান প্রদান করে এ অধিদফতর। সারা দেশে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য জেলা থেকে উপজেলায়, থানা ইউনিয়ন সকল স্তরে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে নারী অধিদফতর।

মহিলাবিষয়ক অধিদফতর গঠনের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় সুফিয়া কামাল, আয়েশা খানমের মত প্রগতিশীল ও ক্ষমতাশীল পরিবারের নারীদের নেত্বত্বে নারী অধিদফতর গঠিত হয়েছে। সিডো বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে নারী উন্নয়নের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সরকার নারীদের তাৎপর্যপূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিকভাবেও চাপ প্রয়োগে সফল হয়েছে নারী নেতৃবৃন্দ।

এদেশের প্রতিবন্ধী নাগরিকদের প্রত্যাশা ছিলো মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের মতো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর হবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন (ডিপিও) এর পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন এর প্রশংসা করলেন আদতে সেই ফাউন্ডেশনের কর্মকান্ডে জাতিসংঘ সনদ সিআরপিডি বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ এবং পরিকল্পনা নেই। প্রধানমন্ত্রী কি জানেন না, এ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনের আর্থিক অনুদানের ৯০% প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কর্মরত তথা সেবাদানকারী এনজিওগুলোকে দেওয়া হয়? অন্যদিকে ডিপিও সংগঠনগুলো কতটা সহযোগিতা পায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কী সে খবর রাখেন? তিনি কি জানেন, ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমেও ডিপিওদের অগ্রাধিকার নেই! বিশেষত তৃণমূলের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত ডিপিওগুলো কেনো সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ অনুদান প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে?

সিআরপিডি এর সকল ধারাই কোন না কোনভাবে লংঘন হচ্ছে সরকারি আমলা এবং সমাজসেবা অধিদফতর ও ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের দ্বারা। অথচ রাষ্ট্রযন্ত্রে বসে থাকা ক্ষমতাসীন এবং প্রতিবন্ধী মানুষের নেতৃত্বধারীরা নীরব ভূমিকায়।

প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য শুধু সামাজিক নিরাপত্তা খাতই একমাত্র খাত হিসেবে বিবেচ্য। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, সংস্কৃতি, ক্রীড়াসহ সকল খাতে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বরাদ্দ বা কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে না। মোটা দাগে সমাজসেবা অধিদফতর এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন এর কার্যক্রম চলছে কল্যাণভিত্তিক আদলে।


অধিদফতর বাস্তবায়নের যৌক্তিকতা
বর্তমানে আমাদের অধিকারভিত্তিক উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট/বিশেষ কার্যক্রম মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন, তদারকি বা আন্তঅধিদফতর সমন্বয়কারী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত একক প্রতিষ্ঠান নেই। সিআরপিডির আলোকে প্রণীত আইন বাস্তবায়ন, প্রচলিত আইনসমূহের সামঞ্জস্যকরণ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়ন, কর্মসূচি তদারকি, সমন্বয় ও পরিবীক্ষণ করতে এ অধিদফতর  প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি। এই অধিদফতর তৃণমূল পর্যায়ের ডিপিওদের এবং বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানসমূহের পৃষ্ঠপোষকতায় ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি এই অধিদফতর কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মীবৃন্দ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। একই সঙ্গে অধিদফতরের কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে জেন্ডার বা শিশু সংবেদনশীল বাজেট কাঠামোর মত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংবেদনশীল বাজেট কাঠামো গড়ে তোলাও সহজ হবে।

জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের আওতায় ৬৪ জেলায় ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের এবং বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে এই কেন্দ্রসমূহের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ ও বেতন প্রদান করা হচ্ছে। এই কেন্দ্রের একটি পদ রয়েছে জেলা প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মকর্তার নামে। এই কেন্দ্রে কর্মকর্তা ও কর্মীরা উন্নয়ন খাতে হওয়া তাদের রাজস্ব খাতে স্থানান্তর নিয়ে সংকট রয়েছে। এই সংকট বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে স্থবিরতার কারণে থমকে আছে অধিদফতর গঠন প্রক্রিয়া। তবে সম্প্রতি প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ কার্যক্রমে মাঠ পর্যায়ে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রগুলোর সক্রিয় ভূমিকা প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতরের প্রয়োজনীয়তাকে জোরালো করেছে। এ ছাড়া অধিকার ও সুরক্ষা আইন অনুযায়ী, বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অভিযোগ প্রদান, প্রতিকারসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার ও সুরক্ষা আইনের জাতীয় সমন্বয় ও নির্বাহী কমিটির এবং সচিবালয়ের দায়িত্ব পালনে এই অধিদফতর কার্যকর ভূমিকা রাখবে। একীভূত সমাজ বিনির্মাণ তথা প্রতিবন্ধী মানুষদের মর্যাদাকর জীবন যাপন নিশ্চিত এবং তাদের সংগঠিত করা বা নেতৃত্বের বিকাশ, দক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ উদ্যোক্তা বিকাশে, গণপরিবহণ, সর্বত্র প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতের জন্য কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিতে পারে এ অধিদফতর।

অতীতে নারী আন্দোলনের সফলতা মহিলাবিষয়ক অধিদফতর যেমন শুধুমাত্র নারী সংগঠনগুলো এবং নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করেছে, তেমনি প্রতিবন্ধী মানুষের স্বতন্ত্র এই অধিদফতর হলে সরাসরি সকল সুযোগ সুবিধাগুলো পাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনসমূহ। নারীদের মতোই প্রতিবন্ধী মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নকে তরান্বিত করে তাদেরকে মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর। তবে এ অধিদফতর এবং সিআরপিডি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধী মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলেই কেবল সরকারের উদাসীনতা ও গড়িমসি কমবে।

প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার- প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিদফতর বাস্তবায়নের দাবীতে সারা দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংগঠিত হওয়া দরকার। কারণ এই অধিদফতরই প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে। আর তাই প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবীতে প্রতিবন্ধী মানুষের দাবী-

★ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধনকৃত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উন্নয়ন অধিদফতর অবিলম্বে বাস্তবায়ন চাই
★ জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অধিকার সনদ CRPD বাস্তবায়নে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিকল্প নেই
★ প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়ন ও অধিকারভিত্তিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ৬৪টি জেলা এবং ৪৯০টি উপজেলায় সরকারের কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে নীতি নির্ধারনী কমিটিসমূহে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হোক


মন্ত্রণালয় ভিত্তিক দায়িত্ব বণ্টনে বাধ্য করতে হবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে

অপরাজেয় প্রতিবেদক

প্রতিবন্ধী নারীর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে বাধ্য করার বিষয়ে বলেন গৃহায়ন ও ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব উম্মে সালমা তানজিয়া। তিনি বলেন,অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলো যেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিষয়ে কাজ করে।তার জন্য প্রয়োজনে বাধ্য করতে হবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে। গত বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাব অডিটোরিয়ামে ‘অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে প্রতিবন্ধী নারীর অংশগ্রহণ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এমন বক্তব্য দেন তিনি। এছাড়াও তিনি নিজের দায়িত্বরত মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রবেশগম্য ভবনের সংখ্যার তালিকা তৈরি এবং অনুষ্ঠানে উত্থাপিত দাবীগুলোর প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখবেন বলে আশ্বাস প্রদান করেন।

অনুষ্ঠানটি প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এর সহযোগিতায় ‘গার্লস অ্যাডভোকেসি অ্যালায়েন্স’ প্রকল্পের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্যা চেঞ্জ এন্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস আয়োজন করে।

বর্তমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চললেও এই উন্নয়ন ধারায় প্রতিবন্ধী নারীরা এখনো বেশ পিছিয়ে। তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। আলোচনা সভায় বক্তারা প্রতিবন্ধী নারীর অংশগ্রহণে প্রধানবাধা হিসেবে প্রবেশগম্যতা, শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর যুগ্ম সচিব গাজীউদ্দীন মোহাম্মদ মুনীর বলেন, অনেক প্রকল্প আছে যেগুলো প্রতিবন্ধী নারীরা অংশগ্রহণ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধিতা কোনো বাধা নয়।সরকার দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিষয়ে যে সকল কার্যক্রম চলছে তা যথেষ্ট নয় বলে অভিযোগ করেন বি-স্ক্যানের সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব। সভাপতির বক্তব্য প্রদানকালে তিনি বলেন, বেশির ভাগ প্রকল্পগুলো সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায়। প্রতিবন্ধী নারীকে কর্মদক্ষ ও ক্ষমতায়িত করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

তাছাড়াও মুক্তআলোচনায় অংশ নেওয়া ফ্রিল্যান্স ওয়েব ডেভলাপার সগীর হোসেইন খান বলেন, নারী বিষয়ক বাজেটে প্রতিবন্ধী নারীদের অন্তর্ভুক্ত নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবন্ধী নারীদের ওয়ান টু ওয়ান প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন এবং যে সকল কর্মজীবি প্রতিবন্ধী নারী আছেন তাদের সন্তানের জন্য কর্মস্থলে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র তৈরি করা অতিব জরুরি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে ডিসএ্যাবল চাইল্ড ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাসরিন জাহান বলেন, মহিলা ও নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর প্রকল্পে চার বছর কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন প্রতিবন্ধী নারীর সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে কম।

অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন বি-স্ক্যানের সমন্বয়কারী ইফতেখার মাহমুদ এবং প্ল্যান ইন্টারনেশন্যাল বাংলাদেশ এর ক্যাপাসিটি ব্লিডিং স্পেশালিস্ট সাব্বির আহমেদ।মূলপ্রবন্ধ পাঠ করেন বি-স্ক্যানের  রিসার্চ এণ্ড এ্যাডভোকেসি কর্মকমর্তা নিশাত আফরোজ।

এছাড়াও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এর উপসচিব ডাঃ এস এম আবুল কাশেম বক্তব্যপ্রদান করেন। আলোচনা চলাকালীন সময়ে সরকারি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠন (ডিপিও), এনজিও এবং পেশাজীবিগণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ।

আলোচনায় বি-স্ক্যান প্রতিবন্ধী নারীর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ নিশ্চিতে নির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ তুলে ধরে। তা নিম্নে দেওয়া হল,

  • মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর বিভিন্ন প্রকল্পে প্রতিবন্ধী নারীর জন্য ১০% কোটার ব্যবস্থা করা।
  • বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে প্রতিবন্ধী নারীর জন্য ১০% কোটার ব্যবস্থা করা।
  • নারীদের জন্য চালুকৃত সকল বাসে প্রতিবন্ধী নারীর জন্য ব্যবস্থা রাখা।
  • প্রতিবন্ধী নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিতে বিশেষ চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা রাখা।
  • প্রতিবন্ধী নারীর বিচারগম্যতা নিশ্চিত করতে ইশারাভাষার সহায়তাসহ সকল ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ।
  • সামাজিক নিরাপত্তাখাতে সাধারণ নারীদের জন্য নির্ধারিত সকল স্কীমে প্রতিবন্ধী নারীর জন্য ব্যবস্থা রাখা।
Translate | অনুবাদ